ফয়সাল আহমেদ
সুন্দরবনের নাম বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
কিন্তু সুন্দরবনে গেলে প্রথমেই সবুজ বনানী’র ভেতর যে চঞ্চল প্রাণীটি মন কেড়ে নেয়, সে হরিণ। শুধু তার শরীরের সৌন্দর্য নয়, তার ডাগর কালো চোখ। যা চোখের উপমাই ছুঁয়ে গেছে নারীর সৌন্দর্যকে, হরিণ নয়না। সুন্দর বনে এই ডাগর চোখের যে হরিণ তার নাম চিত্রা হরিণ বা চিতল হরিণ। এর সঙ্গে আরকেটি শান্ত হরিণ রয়েছে। তার শান্ত মায়াবি স্বভাবের কারণেই নাম হয়েছে মায়া হরিণ।
মায়া হরিণ সংখ্যায় খুবই কম। এদের প্রসঙ্গে পরে আসছি।
চিত্রা হরিণ বা চিতল হরিণকে ধরা হয় পৃথিবীর হরিণ জাতির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হিসেবে। চিতল পুরোপুরিউপমহাদেশের হরিণ। পৃথিবীর নানা এলাকার বনে- জঙ্গলে চিতল ঢোকানো হয়েছে। বর্তমানে আমেরিকারঅঙ্গরাজ্য টেক্সাসের র্যাঞ্চ, জঙ্গলগুলোয় যত চিতল আছে, সম্ভবত উপমহাদেশে তত হরিণ নেই। সুন্দরবনেরভাষায় পুরুষ হরিণকে শিঙেল, মেয়ে হরিণকে মালি বলা হয়। শুধু পুরুষ(শিঙেল) হরিণের শিং গজায়। প্রতিবছর বর্ষার সময় শিংগুলো ঝরে পড়ে। তারপর ভেলভেট মোড়া চামড়ায় নতুন নরম শিং গজায়। ক্রমশ এই শিং শক্তহয়ে গেলে হরিণ গাছে ঘষে চামড়ার আবরণ তুলে ফেলে। পুরুষ হরিণের ঘাড় কিছুটা ফোলা। মালি হরিণ আকারেছোট। ওজনে পুরুষের চেয়ে হালকা, দেহের রংও হালকা সোনালি। দেহের ফোঁটা পুরুষের মতোই। শিং গজায় না।
চিতল হরিণ প্রধানত খোলা বনের প্রাণী। জঙ্গলের ধারে খোলা মাঠে চড়ে বেড়াতে পছন্দ করে। সকাল-বিকেলে মিঠেকড়া রোদে হরিণের দল ঘাসের মাঠে বের হয়ে আসে ঘাস খাওয়ার জন্য। চাঁদনী রাতে, মেঘলা দিনেও হরিণঘাসের মাঠে বের হয়ে আসে। রোদ বেড়ে গেলে হরিণের দল ছায়াছন্ন গাছতলায় চলে যায়। হরিণ যেমন মাঠের ঘাসখায়, তেমনি গাছের পাতাও খেয়ে থাকে। এ ছাড়া ক্যালসিয়ামের ঘাটতি মেটাতে মাটিতে খসে পড়া হরিণের শিং অন্য হরিণ খায়। ক্যালসিয়ামের জন্যই কাঁকড়ার খোসা, চিংড়িমাছ পেলে সেটাও হরিণ খায়।
চিতল হরিণ দলে চলাচল করা প্রাণী। এক এক দলে তিনটি থেকে ২০-২৫টি হরিণ দল বেঁধে চলাচল করে। দলেরনেত্রী একটি বয়সী মেয়ে হরিণ। দুটি মেয়ে হরিণ দলের সেন্ট্রির কাজ করে। পুরুষ হরিণগুলো অধিকাংশ সময়দলের পেছনের দিকে থাকে।
কম বয়সী মেয়ে হরিণের দল সাত-আটটা মিলে ব্যাচেলর দলও তৈরি করে। আবার তিন-চারটা পুরুষ হরিণ মিলেওব্যাচেলর দল-যেগুলোর শিং সবে গজাচ্ছে-তৈরি করে তবে এই ব্যাচেলর দল মূল দলের কাছাকাছিই থাকে।
সুন্দরবনের হরিণ সারা বছর বাচ্চা দিলেও বর্ষার শুরুতে, শীতের শেষে বেশি পরিমাণ বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে।সাধারণত দুটি বাচ্চা একবারে জন্মায়। তিনটি বাচ্চা খুব কম দেখাযায়। হরিণের বাচ্চা জন্মানোর ১৫ থেকে ৩০মিনিটের মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
বড় হরিণের মতো বাচ্চা হরিণের শত্রুও অনেক। বাঘরোল বা মেছো বিড়াল হরিণের বাচ্চা শিকার করে।
হরিণ বাঘ দেখলে যেমন ডেকে ওঠে; তেমনি বড় সাপ, মেছো বিড়াল, শূকর দেখলেও টাউ, টাউ করে ডেকে ওঠে।অস্বাভাবিক গন্ধ শুঁকেও ডেকে উঠতে পারে।
বাঘের ব্যাপারে ডাকাডাকিতে হরিণের কিছু বিশেষত্ব আছে। হরিণ বাঘের আলামত পেলে প্রথম দিকে একটি শব্দ করে যেদিকে বিপদ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথম দিকেই সামনের পা মাটিতে আছড়ে দলের অন্যদের হুঁশিয়ার করেদেয়। তবে এই পা আছড়ানোতে অন্যরা খুব একটা সতর্ক হয় না। তখন ‘টাউ’ বিপদসংকেত বাজলে অন্যরাওবুঝতে চেষ্টা করে বিপদের গুরুত্ব। বিপদ পরিষ্কার হলে হরিণের দল কখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টাউ-টাউ করে। নয়তোদৌড়াতে দৌড়াতে আওয়াজ করে।
হরিণ ভালো সাঁতারু হলেও সহসা জলে নামতে চায় না। জলে নামাটা তার জন্য বিপজ্জনক। পূর্ণিমা অমাবস্যারবড় জোয়ারগুলোতে হরিণের খুব কষ্ট হয়। এ সময় অনেক সময় হরিণদের বুকজলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কুমির এইঅবস্থার সুযোগ নেয়। বাঘও ছাড় দেয় না। বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা জলোচ্ছ্বাসে হরিণের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
পূর্ব সুন্দরবনে বাঘের ৭০ শতাংশ খাদ্য আসে হরিণের মাংস থেকে। অন্ধকার রাতে হরিণের দল বিশ্রাম নেয় কোনোবড় কেওড়া বাগানে নয়তো বাইনগাছতলায়। এই গাছগুলোর তলার জঙ্গল প্রায়ই ফাঁকা থাকে, চারধারেঅনেকখানি দেখা যায়। এখানে অনেকগুলো চোখ, নাকের, কানের সাহায্য পায় বলে থাকার জায়গায় হরিণ বাঘেরহাতে খুব একটা ধরা পড়ে না।
রাতে বিশ্রামের জায়গায় হরিণ অনেক সময় বিক্ষিপ্ত হাঁটাহাঁটি করে। কিন্তু শোবার সময় মাথা সামনের দিক রেখেঅনেকটা চক্রাকারে শুয়ে থাকে। তবে এরা বাঘের মতো মাথা এলিয়ে দেয় না। মাথা তুলেই ঘুমায়।
হরিণ জঙ্গলে হাঁটার সময় কিন্তু এক সারিতে চলে। প্রথম দিকে পাহারাদার হরিণ, তার পরপরই বাচ্চাওয়ালা হরিণী, সবার শেষে পুরুষ হরিণ জঙ্গলে হাঁটে। বাঘ অনেক সময় হরিণ তাড়িয়ে তাদের খালে ফেলে। খালে বেকায়দায় পড়েগেলে বাঘের হরিণ ধরতে সুবিধা হয়।
মায়া হরিণ বনে খুব কম দেখা যায়। পূর্বাঞ্চলের বলেশ্বর নদীর পশ্চিম পাড় থেকে মাঝের বাদার শিবশা নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত এলাকায় এ হরিণ দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয়রা একে বলে খাউইল্লা হরিণ। কারণ এরা বিপদ দেখলে ‘খাউ খাউ’ করে কুকুরের ডাকের মতো ডাক ছাড়ে। আকারেও দেশি কুকুরের সমান। গায়ের রং লালচে বাদামি। গলা বুক হালকা সাদাটে। ওজন সাত থেকে দশ কেজির মধ্যে। মাথায় ইংরেজি V আকারের উঁচু হাড় আছে। এখান থেকে পুরুষ মায়া হরিণের শিং গজায়। ছোট হলেও মায়া হরিণের শ্বাদাঁত আছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ জঙ্গলে এই হরিণ দেখা যায়। মায়া হরিণ সাধারণত নিশাচর, তবে মেঘলা দিনে অথবা আসন্ন সন্ধ্যায় মায়া হরিণ খেতে বের হয়। ঘাস খাওয়ার চেয়ে গাছের পাতা খেতে বেশী পছন্দ করে। মায়া হরিণ একা একা চলাফেরা করতে পছন্দ করে, তবে মা মায়া হরিণকে বাচ্চাসহ চলাফেরা করতে দেখা যায়।
মার্চ-এপ্রিল-মে মাস এদের মিলনের সময়।মায়া হরিণ অত্যন্ত সাবধানী। এদের ঘ্রাণ নেওয়ার শক্তি অসাধারণ।
Leave a Reply