শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-৩৬) মাইক্রোসফ্ট মঙ্গলবার তার সর্বশেষ স্বদেশী ওপেন-সোর্স এআই মডেল প্রকাশ করেছে বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর কাতারের  আমীরের বাংলাদেশ সফর: আগামীর বাংলাদেশের বর্নিল সম্ভাবনা ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত তারুণ্যের উৎসব ‘কার্নিভাল অব চেইঞ্জ ২০২৪’ শনিবার বাংলাদেশ ও কুয়েতের বন্ধুত্বের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন বৃষ্টিপাত না হলে এবং চলমান তাপদহ ও প্রচন্ড গরমে ঈশ্বরদী এলাকায় লিচুসহ ১০ হাজার ১’শ ২৫ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা দিল্লি বোলার রসিখকে জরিমানা করেছে বিসিসিআই জাপান দ্বৈত-ব্যবহারের সামরিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ‘পরিবর্তনের অংশ’ হিসেবে দেখে মধ্যবিত্তের নিজস্ব সুপার শপ স্বপ্ন – সাব্বির হাসান নাসির

মাতৃভাষা থেকে জাতিরাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি

  • Update Time : বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ১২.২৪ এএম

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

বাংলা অঞ্চলের মতো বাংলা ভাষার চরিত্রও গতিময় এবং উদার। বাংলায় যেমন নানা প্রান্তের মানুষ এসে লীন হয়েছে, তেমনি নানা ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় এসে মিশে গিয়েছে। তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি ভাষার অসাধারণ সমন্বয় ঘটেছে বাংলায়। ভূমি হিসেবে বাংলা যেমন সবাইকে আপন করে নেয়, তেমনি ভাষা হিসেবেও বাংলা তার উদারতা দেখিয়ে এসেছে শুরু থেকেই। এ কারণে বাংলা এখানকার মানুষের প্রাণের ভাষায় পরিণত হয়েছে।
ভাষা নিয়ে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশকারী এথনোলগ ২০২৩ সালে প্রকাশিত ল্যাঙ্গুয়েজেস অফ দি ওয়ার্ল্ড শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলা পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। আবার কোনো হিসেবে এর অবস্থান সপ্তম। একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে বাংলায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ মানুষ। ভারতেও বাংলা দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষায় পরিণত হয়েছে। আমেরিকাতে তেলেগুর পর এখন বাংলা হচ্ছে দ্বিতীয় ক্রমবর্ধনশীল ভাষা। সারা পৃথিবীতে দ্রুত বেড়ে ওঠা ভাষার তালিকায় বাংলার অবস্থান চতুর্থ। টাইমস অফ ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ইউনেস্কোর একটি আনঅফিসিয়াল জরিপে বাংলা পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
মাতৃভাষাকে মানুষ সহজাত হিসেবে গ্রহণ করে বলেই পৃথিবীতে সব শাসকই চান তার নিজের মাতৃভাষা যেন সবার ব্যবহারিক ভাষায় পরিণত হয়। এ কারণে বাংলা শাসনকারীরা কখনো ফারসি, কখনো ইংরেজি কিংবা কখনো উর্দুকে দাপ্তরিক ভাষায় পরিণত করতে চেয়েছেন। সুলতানি আমলে এদের কেউ কেউ স্থানীয় মানুষের আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের ভাষা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া চেষ্টা করেছেন।
বাংলা ভাষা এ অঞ্চলে বিকশিত হয়েছে প্রকৃতির মতো। বাংলা ভাষার শেকড়ের রস সৃষ্টি হয়েছে এই অঞ্চলের মাটির গভীর থেকে। ফলে কোনো শক্তিই বাংলাকে দমন করতে পারে নি। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কোনো লেখক বা গবেষক যদি দীর্ঘদিন মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকতে চান তবে তিনি যেন মাতৃভাষায় লেখেন।
মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে এদেশের মানুষ প্রথম প্রাণ দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশের বাইরেও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে।
আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল সরকারি ভাবে অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষায় পরিণত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ১৯ মে ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে রাজ্য পুলিশ। ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের তামিলনাড়ুতে তামিল ভাষার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে হামলা এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে এক সপ্তাহে ১৫০ জন মারা যান। ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তামিলনাড়ুতে হিন্দি ভাষার প্রাধান্যের বিরুদ্ধে হাজারো তামিল তরুণ পথে নামেন। পুলিশ ১৫ হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। কোনো একক নেতৃত্ব নয়, বরং সময়ের প্রয়োজনে একেক সময় তা পরিবর্তিত হয়। অনেকটা রিলে রেসের মতো। একজন শুরু করেন তারপর আরেকজন তা টেনে নিয়ে যান। এ কারণে ভাষা আন্দোলন এদেশের নানা প্রান্তের মানুষের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে পরিচালিত একটি আন্দোলন। ইতিহাসবিদ, জাতীয় অধ্যাপক এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভাষা হচ্ছে মানুষের প্রাণ। সেখানে যখন আঘাত লাগে, সে আঘাত সহ্য করা যায় না।’

প্রথম পর্যায় : ভাবনার প্রকাশ
বাংলা ভাষা আন্দোলন অনন্য এ কারণে যে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সাংস্কৃতিক, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক যে আন্দোলনের সূচনা হয় তার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় এক জাতিরাষ্ট্রের। এমন উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ১০০ বছরেরও বেশি সময়ের আগে শুরু হয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে এই অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ নেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। তাকে ভাষা আন্দোলনের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ বলা যেতে পারে। ১৯১৭ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের ভাষণে তিনি বলেন, ‘যদি পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় না ঘটিত, তবে হয়তো এই পুঁথির ভাষাই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পুস্তকের ভাষা হইতো।’
তরুণ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার দৃঢ়চেতা মনোভাবের প্রকাশ ঘটান ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সভায় বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে। তখনো ভারত স্বাধীন না হলেও ভারতের প্রধান ভাষা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে এই আলোচনা হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ও সভাপতিত্বে এই সভায় ড. তারাপুর ওয়ালা, বিধুশেখর শাস্ত্রী, অধ্যাপক হেমন্ত সরকারসহ অনেক সর্বভারতীয় ভাষাবিদ অংশ নেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ প্রায় সকল ভাষাবিদ হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন। তরুণ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন। তিনি বাংলাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন। বাংলাকে ভারতের ‘লিংগুয়া ফ্রাংকা’ হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন তিনি। বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকজন পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য নিজেদের ভাষা বাদ দিয়ে যখন কমন বা সাধারণ কোনো তৃতীয় ভাষা ব্যবহার করেন সেই ভাষাটাকে লিংগুয়া ফ্রাংকা বা ব্রিজ ল্যাঙ্গুয়েজ অর্থাৎ যোগাযোগকারী ভাষা বলে। তিনি বলেন, ‘শুধু ভারতবর্ষে কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ।’
বাংলার পক্ষে আর কেউ মতামত না দিলে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে বাংলা, হিন্দি ও উর্দু তিন ভাষাকেই ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাব অধিকাংশেরই পছন্দ হয় নি। মহাত্মা গান্ধীর এক চিঠির জবাবেও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দির পক্ষে অভিমত দেন।
বাংলার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজটি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজীবন করে গিয়েছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের আগেই ১৯৪৭ সালে জুলাইয়ে আলীগড় ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এর বিরুদ্ধে যারা তীব্র প্রতিবাদ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তাদের অগ্রগণ্য। তিনি ২৯ জুলাই ১৯৪৭ সালে সে সময়ের প্রভাবশালী দৈনিক আজাদে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শিরোনামে এক কলামে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যুক্তি তুলে ধরেন। প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রকাশ্য দাবিকারী প্রথম মানুষটি হলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। ৩ আগস্ট ১৯৪৭ সালে কমরেড পত্রিকায় লেখেন ‘দি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম অফ পাকিস্তান’ শিরোনামে কলাম। তখনো পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করে নি। এই সময় তিনি কলামটিতে লেখেন, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাংলাভাষী অংশে যদি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে সেই স্বাধীনতা হবে পরাধীনতার নামান্তর।’
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে আরো অনেককে নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার মানস গঠনে শুধু বক্তব্য দেয়া নয়, একের পর এক কলাম লিখেছেন বাংলা এবং ইংরেজিতে। দি উইকলি, কমরেড, আজাদসহ সে সময়ের প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোতে তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে লিখে জনমত গড়ে তোলেন।

দ্বিতীয় পর্যায়: অধিকারের লড়াই
ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ভাষা না হলে নেশন বা জাতি হয় না এবং ভাষা সম্পর্কে সচেতন না হলে জাতীয়তাবোধও আসে না।’
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগেই রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয় যেখানে পূর্ব বাংলায় প্রধান ভাষাই হলো বাংলা। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত তমদ্দুন মজলিশ সংগঠনটির উদ্যোক্তা ছিলেন সে সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও পরে অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল কাসেম। তিনি পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষায় পরিচালিত প্রথম কলেজ হিসেবে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে একটি সভা ডেকেছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। সেখানে তারা বাংলা ভাষার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলাপ করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-এ তমদ্দুন মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উর্দু?‘ নামে একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা প্রকাশ করে। পুস্তিকাটিতে সে সময়ের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক কাজী মোতাহের হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম বাংলার পক্ষে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন। পুস্তিকাটিতে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয় বাংলার পক্ষে। গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো ছিল :
Ñ বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তানের তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যম।
Ñ বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা।
Ñ বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষা।
Ñ উর্দু ও বাংলা দুটোই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা হবে।
Ñ পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হবে বাংলা, যা সব শ্রেণীর মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

সে সময় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এ ধরনের বাংলা বিরোধী মনোভাবের প্রতিবাদে ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পক্ষে নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। ৭ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে দাবি জানানো হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবিতে ১৭ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে হাজারো নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে দেয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ৬ ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম প্রকাশ্য সমাবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ এখানে অংশ নেন। সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, আবদুর রহমান, এ কে এম আহসান, ডাকসু সভাপতি ফরিদ আহমেদসহ আরো অনেকে।
বাংলা ভাষার দাবিতে ১৯৪৭ সালে যে প্রতিবাদের সূচনা হয় ১৯৪৮ সালে তা ব্যাপকতা পায়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে গণপরিষদের সভা যখন চলছিল তখন পূর্ববঙ্গে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন প্রবল বেগবান। ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদে প্রথমবারের মতো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি প্রস্তাব করেন গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার। তিনি আরো বলেন যে সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ লোক বাংলায় কথা বলেন। বাংলার অধিকার নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি। তার প্রস্তাবে ক্ষোভে ফেটে পড়েন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠায় গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান এবং পাকিস্তানি শাসকদের বাংলাকে অগ্রাহ্য করার মানসিকতায় পূর্ব বাংলায় ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে।
পাকিস্তানি শাসকদের বাংলা বিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বিশাল মিছিল বের করেন। রমনা এলাকায় এই মিছিল শেষে প্রতিবাদ সভায় সিদ্ধান্ত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রতিবাদ দিবস’ পালন করার। অধ্যাপক আবুল কাসেম ছিলেন এই সভার সভাপতি।
২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে তমুদ্দিন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের এক সভায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সর্বদলীয় প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় ১১ মার্চ সমগ্র পাকিস্তানে ধর্মঘট পালন করার। সভায় সভাপতিত্ব করেন কামরুদ্দীন আহমদ। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন রণেশ দাসগুপ্ত, অধ্যাপক আবুল কাসেম, অজিত কুমার গুহ, আজিজ আহমদ, সরদার ফজলুল করিম, নঈমুদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল আলী, শামসুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আলী আহমদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, অলি আহাদ, শওকত আলী, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ, লিলি খান, আনোয়ারা খাতুন, মহিউদ্দিন, শামসুল আলম, কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুল আউয়ালসহ আরো অনেকে।
এই সভার প্রেক্ষিতে ১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখের পত্রিকায় ১১ মার্চের হরতাল সফল করার একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন তমদ্দুন মজলিস সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেম, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত দেশপ্রেমিক গণনেতা, ছাত্র ও যুব-কর্মীগণকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি ধর্মঘটকে সম্পূর্ণ সফল করার জন্য যেন তারা এখন থেকে প্রস্তুত হতে থাকেন। … আমরা পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে আবেদন জানিয়ে বলি: ওঠো, জাগো, এই ষড়যন্ত্রকে তোমাদের নিজ শক্তি বলে চুরমার করে দাও। দেশব্যাপী এমন আন্দোলন গড়ে তোল, যার ফলে বাংলাকে অচিরে আমাদের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করতে সরকার বাধ্য হন।’
১০ মার্চ অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে চূড়ান্ত প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এটা পরিণত হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সফল ধর্মঘটে। ১১ মার্চ সকাল থেকেই শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক নেতারা পিকেটিং শুরু করেন। বিশেষ করে সচিবালয়ের দুই গেটই তারা আটকে দেন। পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনকারীদের ওপর। রক্তঝরা আন্দোলনে পরিণত হয় এই ধর্মঘট। ঢাকার বাইরেও এই ধর্মঘটে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। রাজশাহী ও সিলেটে অনেক আন্দোলনকারী রক্তাক্ত হন পুলিশি হামলায়।
ঢাকায় এই ধর্মঘটে পুলিশি হামলায় আহত হন বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক, তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ভিপি মোহাম্মদ তোয়াহাসহ আরো অনেকে। পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেফতার হন কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ, শওকত আলী, খালেক নেওয়াজ খান, নঈমুদ্দীন আহমদ, বায়তুল্লাহ, রণেশ দাশগুপ্তসহ আরো অনেকে। এদিন প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
জানা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন ৯০০ জন। এদের অনেককে পড়ে ছেড়ে দেয়া হলেও ৬৯ জনকে জেল হাজতে পাঠানো হয়। আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এদিন ২০০ জন আহত হন। যাদের মধ্যে ১৮ জন গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
এতো অত্যাচার করেও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাদের সরকারি প্রেসনোটে জানায়, ‘কতিপয় বিভেদ সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রের দুশমন এই ধর্মঘটে যোগ দিয়াছিল।’
সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে আন্দোলনকারীগণ ধর্মঘট অব্যাহত রাখেন ১২ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। ১৩ মার্চ যশোরে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। এই আন্দোলনে ভয় পেয়ে স্থানীয় প্রশাসন বাধ্য হয় সমঝোতামূলক চুক্তি করতে। তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেন। যদিও তা ছিল প্রতারণাপূর্ণ চুক্তি। কিন্তু ১১ মার্চের এই আন্দোলন সরকারকে প্রথমবারের মতো মাথা নত করতে বাধ্য করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির যুগান্তকারী ঘটনার আগে পর্যন্ত ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হতো।

১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন। তিনি যখন জানতে পারেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের ‘জাতির পিতা’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আসবেন তখন তিনি পরিবেশ শান্ত রাখার স্বার্থে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কাছে আট দফা প্রস্তাব দেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার আসার পর কী বলেন সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তিনি সংগ্রাম পরিষদকে অনুরোধ করেন। সংগ্রাম পরিষদের মূল নেতৃত্বে ছিল তমদ্দুন মজলিস। তাদের এবং সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্বের একটি বড় অংশই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছিলেন এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি তাদের অগাধ আস্থা ও মুগ্ধতা ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলার পক্ষে কথা বলবেন। অধ্যাপক এম. এ কাসেমসহ অনেকেই আন্দোলন স্থগিতের পক্ষে মত দেন। তবে মোহাম্মদ তোয়াহা এবং তাজউদ্দীন আহমদসহ তুলনামূলক তরুণ নেতৃত্ব কিছুতেই আন্দোলন স্থগিতের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু সিনিয়র নেতাদের সিদ্ধান্তে আন্দোলন ১৫ মার্চ ১৯৪৮ থেকে স্থগিত করা হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এলেন ১৯ মার্চ ১৯৪৮। তিনি প্রথমে তিনি ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দান বা বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সংবর্ধনায় সবাইকে হতাশ করে দিয়ে ঘোষণা দেন, ‘উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’।
প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সেখানে। অনেক ছাত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে নিয়ে বানানো তোড়ন ভাংচুর এবং ছবি ছিড়ে ফেলেন। যা ছিল তখনকার সময় বিরল ঘটনা। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার অবস্থানে অনড় থাকেন। একই কথার প্রতিধ্বনী তিনি করেন ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। তিনি আরো বলেন, ‘যারা তার কথার বিরোধিতা করে তারা পাকিস্তানের দুশমন।’
ছাত্রদের ‘নো নো’ ধ্বনী প্রকম্পিত হয় সেখানে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ব্যাপক অস্থিরতার তৈরি করে। এ সময় বড় নেতাদের মধ্যে এ.কে. ফজলুল হক প্রকাশ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। ছাত্র জনতার প্রতিবাদের মধ্যেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা ছেড়ে যান।
এই ধাক্কা ছিল বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের জন্য স্বপ্নভঙ্গের এক নতুন অভিজ্ঞতা। যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য তারা সর্বাত্মক আন্দোলন করেছিলেন সেই পাকিস্তান তাদের কাছে আর আপন রইলো না। অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কারণ তারা ধারণাও করেন নি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলার পক্ষে কথা বলবেন না। এ সময়টায় আন্দোলন কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়ে।

তৃতীয় পর্যায়: আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল মতিন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিতেন। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিতে বলে। তিনি এটি করতে অস্বীকার করলে তিন বছরের জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি সব সময়ই ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং বাংলা ভাষার প্রতি অনুরক্ত। একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মাহমুদ হাসানের ইংরেজি প্রশ্নের জবাবে তিনি সচেতন ভাবে বাংলায় উত্তর দিলে ভিসি বিস্মিত হন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার বহিষ্কৃত অবস্থায় ১৯৫০ সালের মার্চ মাসের শুরুর দিকে কিছুটা হতাশ ও নিষ্ক্রিয় আবদুল মতিন যখন নিমতলীর এক রেস্টুরেন্টে যখন নাস্তা খাচ্ছিলেন তখন ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রদের আরো সক্রিয় হওয়া প্রসঙ্গে পাশের টেবিলে বসা দু’জন বাঙালি সরকারি কর্মচারীর কথা তার কানে আসে,‘ছাত্ররা এভাবে থেমে গেল গেল কেন? তারা আবার শুরু করলেই তো তাদের সমর্থন করে বাংলা ভাষার জন্য দেশব্যাপী আন্দোলন হতে পারে।’
কথাগুলো শোনার পর আবদুল মতিন তার অনুভূতি নিজেই বর্ণনা করেন এভাবে,‘ তাদের কথাবার্তা শুনে আমার যেন চোখ খুলে গেল। আমার কাছে সমস্ত কিছু দিবালোকের মতো পরিস্কার হয়ে গেল। ভাষা ও জাতি সম্পর্কিত নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো, আমি করণীয় পেয়ে গেলাম। তাদের কথাগুলোর তাৎপর্য উপলব্ধি করে আমি যেন ভিন্ন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম।’
কথাগুলো তাকে এতো বেশি অনুপ্রাণিত করলো যে ১১ মার্চ ১৯৪৮-এর দ্বিতীয় বার্ষিকী হিসেবে আয়োজিত ছাত্র সভায় নিজেকে আর আড়াল না করে নিজ থেকে কিছু বলার অনুমতি চাইলেন। ভাষা আন্দোলনে এর আগে তার উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। তাকে কথা বলার অনুমতি দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর আমরা ১১ মার্চ উদ্যাপন করছি। এটা একটা গতানুগতিকতা, কেবল এ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা যাবে না। সকল মানুষ, সমগ্র জাতি তাদের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেতে চায়। তারা এর জন্য ভরসা করছে ছাত্রদের ওপর। ছাত্ররাই এ আন্দোলনের স্বাভাবিক ও প্রাথমিক নেতৃত্ব। প্রশ্ন হলো, ছাত্ররা তাদের এ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে কি না? ছাত্ররা এ আন্দোলন শুরু করলে আপামর জনগণ তাদের ভাষার জন্য এ আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করবে এবং সেই কারণে তা অতি অবশ্যই জয়যুক্ত হবে।’
তার এ বক্তব্য ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে। আবদুল মতিনের কাছেই করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলেন উপস্থিত সবাই। তিনি প্রস্তাব করেন, দলমত নির্বিশেষে যারাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত সে সব সংগঠনের মধ্য থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি করার। যে কমিটি আন্দোলনের দিক নির্দেশনা দেবে।
তার প্রস্তাব সবাই মেনে নিলেন। সেদিনই গঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। এবার এলো আহ্বায়ক মনোনয়নের পালা। আবদুল মতিনের বক্তব্য এতো বেশি অনুপ্রেরণামূলক ছিল যে উপস্থিত ছাত্রদের দাবির মুখে তাকেই আহ্বায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘটনা আবদুল মতিনকে পরিণত করে ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে আলোচিত সময় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতায়। তার অনন্য অবদানের জন্য আবদুল মতিনের নাম মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ‘ভাষা মতিন’ হিসেবে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পুরো সময়কালে সবচেয়ে আলোচিত দিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে পৃথিবীতে প্রাণ দেয়ার ঘটনা এই প্রথম ঘটে। ১৯৫২ সালের শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। নানা কর্মসূচির মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, সভা ও বিক্ষোভের ডাক দেয় ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। সাধারণ মানুষের সমর্থন এই দিনটি নিয়ে শাসকদের ভাবিয়ে তোলে। যার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানি সরকার ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য রাখায় ১৩ ফেব্রুয়ারি অবজারভার পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয় এবং এর সম্পাদক আবদুস সালাম ও প্রকাশক হামিদুল হক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও বিশ^বিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি করে পুস্তিকা প্রকাশ করে। সর্বদলীয় পুস্তিকাটি লেখেন বদরুদ্দীন উমর এবং ছাত্রদের পক্ষে পুস্তিকাটি লেখেন আনিসুজ্জামান। এদিন পরিস্থিতি এতো বেশি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে যে নুরুল আমীন সরকারের পক্ষে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস এইচ কোরেশী সমগ্র ঢাকা এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেন।
একই দিন সন্ধ্যায় সর্বদলীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যৌথ বৈঠক হয়। প্রবীণ নেতা আবুল হাশিম সভাপতিত্ব করেন বৈঠকের। ছাত্রদের অংশের নেতৃত্ব দেন আবদুল মতিন। ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কিনা এই প্রশ্নে দুই অংশ বিভক্ত হয়ে পড়েন। অধিকাংশ সিনিয়র নেতা ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে মত দিলে ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করেন। আবদুল মতিন মতামত দেন পরদিন আমতলার সমাবেশেই ঠিক করা হবে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি না। নেতারা তার বক্তব্য মেনে নেন। ২০ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা হল বা বর্তমান শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে গাজীউল হকের নেতৃত্বে ১১ জন ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভাঙার গোপন সিদ্ধান্ত নেন।
পরদিন বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন আমতলায় রাজনৈতিক দলের কর্মী ও ছাত্রদের সমাবেশ ঘটে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী সেখানে উপস্থিত হন। পুরো এলাকায় কঠোর অবস্থান নেয় পুলিশ। সংঘাতের আশংকায় রাজনৈতিক নেতাদের একটি অংশ ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে মত দিলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্রসমাজ। আবদুল মতিন ও গাজীউল হকের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত জানান ছাত্রনেতারা। পরে সভায় সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভাঙতে ১০ জন করে একেকটি দল বের হয়ে যাবে একের পর এক। এদের মধ্যে চতুর্থ দলটি ছিল ছাত্রীদের। দলগুলো যখন বের হচ্ছিল পুলিশ তাদের বেশির ভাগকেই গ্রেফতার করে ফেলে।
এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে মোড় নেয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়। শুরু হয় পুলিশের নির্দয় লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ। সারাদিন ধরেই চলে সংঘর্ষ। এদিন বিধান সভার বৈঠক ছিল বর্তমান জগন্নাথ হলে। ছাত্ররা দুপুরের পর সেখানে ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাসের প্রতিবাদে ইট পাটকেল ছুঁড়ছিলেন ছাত্ররা। এরই মধ্যে ঘটে ইতিহাসের এক কলঙ্কময় ঘটনার। মিছিলরত ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। রফিক উদ্দিন লুটিয়ে পড়েন। প্রথম ভাষাশহীদ হন তিনি। একে একে মারা যান জাব্বার, বরকত, সালাম, সফিউরসহ আরো অনেকে। পুলিশ আহত ও নিহতদের সরিয়ে নিচ্ছিল তাদের গাড়িতে করে। অনেকেই মনে করেন, ভাষা আন্দোলনে যে শহীদদের নাম আমরা জানি তাদের চেয়ে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন। যাদের মৃতদেহ পুলিশ লুকিয়ে ফেলে। গোপনে শহীদ রফিকের গুলিবিদ্ধ মাথার ছবি তুলে আলোড়ন তোলেন ফটোগ্রাফার আমানুল হক। একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশি হামলা ও ছাত্রদের প্রতিরোধের মধ্যে মিছিলে অংশ নিতে এসে বেশ কয়েকজন স্কুলের শিক্ষার্থী আটকা পড়ে যায়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ নিজে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেডিক্যাল কলেজের দেয়াল ভেঙে তাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। একুশের হতাহতের কথা শোনামাত্র তিনি হসপিটালে আহতদের দেখতে যান। একুশের শহীদদের কথা জেনে প্রথম কালো ব্যাচ ধারণ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। নিজের কালো আচকান কেটে তিনি এই ব্যাচ বানিয়েছিলেন তিনি।
২১ ফেব্রুয়ারি বিধান সভার বৈঠকে পুলিশি গুলি, হত্যা, নির্যাতনের প্রতিবাদে ৩৫ জন সদস্য সেখান থেকে এক যোগে বেরিয়ে আসেন। ছাত্রনেতাদের বড় অংশই গ্রেফতার হয়ে গেলে নতুন নেতৃত্ব ঠিক করে আন্দোলনের কর্মকৌশল ঠিক করা হয়ে। এতে সিনিয়র নেতারাও যোগ দেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ও পরের কয়েকদিন আন্দোলন শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার তৈরি হয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই। ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণ, ভাষাসৈনিকদের শহীদ হওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। প্রতিবাদের আগুন জে¦লে ওঠে সর্বত্র। রাজশাহীও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজশাহী কলেজের মুসলিম হলের এ ব্লকে এক সভায় রাজশাহী মেডিক্যালের এস.এম.এ গাফফারকে সভাপতি এবং রাজশাহী কলেজের হাবিবুর রহমান ও আরিফ টিপুকে যুগ্ম সম্পাদক করে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। জরুরি ভিত্তিতে ছাত্ররা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর থেকে ছাত্ররা ইট কাদামাটি, বাঁশ দিয়ে এই মিনার তৈরি করেন। রাত ১২টা ১ মিনিটে তারা সেখানে শ্রদ্ধা জানান। ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় জমে। কিন্তু কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পুলিশ এসে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে দেয়।
ঢাকায় প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। এই কাজ মূলত করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাক হোস্টেলে থাকা ছাত্ররা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের ভি.পি গোলাম মাওলা এই উদ্যোগ নেন। তার অনুরোধে শহীদ মিনারের নকশা করেন বদরুল আলম। ছাত্র সংসদের জি. এস শরফুদ্দিনের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় চলে শহীদ মিনারের কাজ। যদিও তখন এর নামকরণ হয়েছিল শহীদ স্তম্ভ। পুরানো ঢাকার সাব-কনট্রাক্টর পিয়ারু সরদার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তার বাসা থেকে গুদামের চাবি এনে সিমেন্ট আনা হয়। কলেজের সংস্কার কাজের জন্য ইট বালি ছিল আগে থেকেই। শীতের রাতে এই মিনারের কাজ শুরু এবং শেষ হয়। ১০ ফিট উঁচু এবং ছয় ফিট চওড়া ছিল এই স্মৃতি স্তম্ভ।
২৪ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ সফিউরের বাবাকে দিয়ে ঘরোয়া ভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়। হাজার হাজার মানুষ শহীদ মিনার দেখতে আসেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের গুলি করার প্রতিবাদে আইন পরিষদ থেকে পদত্যাগকারী ও সিনিয়র সাংবাদিক আবুল কালাম সামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ধোধন করেন শহীদ মিনার। বিষয়টি এতো বেশি আলোচিত হয় যে শাসকগোষ্ঠী সেদিন সন্ধ্যাতেই পুলিশ দিয়ে শহীদ মিনারটি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। প্রতিবাদী ছাত্রদের মধ্যে ৭০জন গ্রেফতার করে পুলিশ।
এর পরের বছর ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে কাগজ দিয়ে একটি প্রতীকী শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। কালো কাপড়ে ঘেরা এই শহীদ মিনারই হয়ে ওঠে শ্রদ্ধা জানানোর জায়গা। তবে একই বছর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কার্জন হল ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ছাত্ররা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন। ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজের ছাত্রীরা মিলে শহীদ মিনার বানাতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে শেষ করতে পারেন নি।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে সকল ভাষাসৈনিক শহীদ হন তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে অনেকের মধ্যেই চিন্তা ভাবনা কাজ করে। বছরের শুরুতেই তমদ্দুন মজলিস তার কেন্দ্রীয় কমিটির এক সিদ্ধান্ত অনুসারে ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। একই সিদ্ধান্ত নেয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩ ফেব্রুয়ারি এক সভায়। রাজনীতিবিদদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সে সময়ের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান।
১৯৫৩ সালেই প্রথম স্বতস্ফূর্ত প্রভাত ফেরী শুরু হয়। অসংখ্য মানুষ খালি পায়ে লাইন ধরে অস্থায়ী শহীদ মিনার এবং শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বস্তরের মানুষের শোভা যাত্রা বের হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। পথে এই শোভাযাত্রকে লক্ষ করে ছাদ থেকে ফুল ছিটিয়ে সম্মাননা জানান বিভিন্ন এলাকাবাসী।
বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টির নেতানেত্রীদের নিয়ে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে এক জনসভা হয় আরমানিটোলায়। শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, মাহমুদ আলী, হালিমা খাতুন, আখতার উদ্দিন, ইব্রাহিম ত্বাহা, এম. এ ওয়াদুদ, গাজীউল হক প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার তখন বন্দী ছিলেন অনেক রাজনৈতিক নেতা ও ভাষা আন্দোলনকারী। তারা ভিন্ন ভাবে জেলের ভেতরে দিনটি পালন করেন। অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ তার এক জোড়া সিল্কের মোজা কেটে বানান কালো ব্যাজ। মোহাম্মদ তোয়াহা কালো উলের কার্ডিগান কেটে কালো পতাকা তৈরি করেন। তাদের সঙ্গে দিনটি পালন করতে কাজ করেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ। এদিকে জ্যেষ্ঠ নেতাগণ কেন্দ্রীয় কারাগারেই এক দিনের অনশন করেন। মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, ওসমান আলীসহ আরো অনেকে এতে অংশ নেন। তারা দাবি করেন তাদের এই এক দিনের খোরাকির টাকা যেন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের ফান্ডে দান করা হয়।
কেন্দ্রীয় কারাগারে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ছিল নাটক অভিনয় করা। ১৯৫৩ সালের শুরুতে জেলবন্দী রণেশ দাসগুপ্ত চিরকুট পাঠিয়ে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করেন একটি নাটক লেখার। জেলখানার ভেতর নাটক করা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। মুনীর চৌধুরী ১৭ জানুয়ারি জেলে বসেই লিখে ফেললেন অনন্য সাধারণ নাটক- কবর। ঠিক হলো জেলবন্দীরাই নাটকে অভিনয়ে নেবেন। মুনীর চৌধুরী নাটকটি রচনা করলেন এমন ভাবে যাতে তা অভিনয় করতে সহজ হয়। কবর নাটকটি ২১ ফেব্রুয়ারি উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। রাত দশটায় যখন কারাগারের বাতি নিভিয়ে দেয়া হয় তখন হারিকেন জ্বালিয়ে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় জেলের ভেতর!
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ছাত্রজনতার অহিংস আন্দোলনে পুলিশি গুলিতে হতাহতের ঘটনায় সবাই প্রথমে হতবাক হয়ে পড়েন। এরপরই শুরু হয় প্রতিবাদের ঝড়। সে সময় বিশ বছর বয়সী তরুণ কবি ও সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আমীর আলী ও আরেক সহযোদ্ধাকে নিয়ে জরুরি আলাপ করে একটি লিফলেট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পুরানো কেন্দ্রীয় জেলখানার বিপরীতে ক্যাপিটাল প্রেসে বসে নিজেই লিফলেট লিখে সেটা প্রকাশ করেন হাসান হাফিজুর রহমান। প্রেস মালিক সব কাজ বাদ দিয়ে মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যেই লিফলেটটি ছেপে দেন। এটিই ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে প্রথম কোনো প্রকাশনা। হাসান হাফিজুর রহমান শুধু লিফলেট প্রকাশেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। অকৃত্রিম বন্ধু ও রাজনৈতিক কর্মী মোহাম্মদ সুলতানকে নিয়ে তিনি নানা পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের যৌথ চিন্তাতে পরের বছর ১৯৫৩ সালে একটি সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নেন তারা। মোহাম্মদ সুলতান ও তাদের আরেক বন্ধু এম. আর. আখতার মুকুল মিলে পুঁথিপত্র নামে একটি বইয়ের দোকান চালাতেন। সেই পুঁথিপত্রের ব্যানারেই সংকলনটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হলেও কারোরই হাতে টাকা ছিল না। হাসান হাফিজুর রহমান টাকার অভাবে তার গ্রামে বাড়ি গিয়ে কম দামে একখ- জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসেন।
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে প্রকাশিত এই সংকলনটিতে যারা লিখেছিলেন তখন তারা অধিকাংশই তরুণ হলেও সে সময় ও পরবর্তী সময়ে তাদের অধিকাংশই জাতীয় ভাবে পরিচিতি লাভ করেন। সম্পাদকীয় লিখেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ নামে প্রবন্ধ লেখেন আলী আশরাফ। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিখ্যাত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি এই সংকলনে প্রথম প্রকাশিত হয়। আরেকটি গান লেখেন তোফাজ্জল হোসেন। কবিতা লিখেছিলেন শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালউদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও হাসান হাফিজুর রহমান। একুশের গল্প লেখেন শওকত ওসমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম এবং আতোয়ার রহমান। একুশের ঘটনাপঞ্জি লেখেন কবিরউদ্দিন আহমদ। আরো লিখেছেন সালেহ আহমদ ও তোফাজ্জল হোসেন। একুশের নকশা অংশে লেখেন মর্তুজা বশীর। তিনি বেশ কয়েকটি স্কেচ করেন। বিজন চৌধুরীর আঁকা ইলাস্ট্রেশনও ব্যবহার করা হয়। প্রচ্ছদ শিল্পী আমিনুল ইসলাম। সম্পাদকের সঙ্গে সংকলনটির প্রুফ দেখেন আনিসুজ্জামান।
বই আকারে প্রকাশিত সংকলনটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮৩, প্রথম প্রকাশ হয় মার্চ ১৯৫৩ সালে। পাইওনিয়ার প্রেসের পক্ষে এম এ মুকিত ছিলেন মুদ্রাকর এবং সংকলনটির ব্লক তৈরি করে এইচম্যান কোম্পানি। দাম রাখা হয় আড়াই টাকা। সংকলনটি প্রকাশের পরপরই তা পকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করে এবং প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। প্রেসসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৫৬ সালে সংকলনটির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তানি শাসকরা নানা ভাবে আন্দোলনকারীদের দমনের চেষ্টা করে চলে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি বছরই পুলিশি জেল নির্যাতন চলতে থাকে। এই নির্যাতন নতুন মাত্রা পায় ১৯৫৫ সালে। এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্তুতি যখন নেয়া হচ্ছিল তখনই ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কালো ব্যাজ ধারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরপর সরকার শহীদ দিবস পালনের ওপরই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। ১৯৫৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে আন্দোলনের আরেক মাইলফলক। সব ধরনের কর্মসূচিতে পুলিশের বাধার মুখে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ও জনতা একুশে ফেব্রুয়ারিতে পথে নামেন। এ ছিল দেশ জুড়ে এক অস্তিত্বের সংগ্রাম। পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাস এবং গুলির পাশাপাশি চলে গণগ্রেফতার। ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকসহ বেশ কিছু পত্রিকায় এর প্রতিবাদে সম্পাদকীয় ও লেখা প্রকাশিত হয়।

চতুর্থ পর্যায় : স্বীকৃতি ও শিক্ষায় বাংলার ব্যবহার
ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটে। ৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। মার্চ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে হারিয়ে যুক্তফ্রন্টের বিশাল জয় ছিল ভাষা আন্দোলনেরই প্রত্যক্ষ প্রভাব। নির্বাচনে জয়ী হয়েই শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক বাংলা ভাষাকে স্বাধীন করার ঘোষণা দেন। যুক্তফ্রন্টের নেতাদের সাহসী কর্মকান্ডের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুতই এই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেয়।
পাকিস্তান গণপরিষদে ১২ আগস্ট ১৯৫৫ সালে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তৃতা করেন। একই বছর ২৫ নভেম্বর বাংলাকে সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবিতে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। বাংলা ভাষা নিয়ে উচ্চতর গবেষণা ও ভাষার বিকাশে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা হয়।
ব্যাপক আন্দোলনে নাজেহাল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করে বাংলাকে দূরে সরিয়ে রাখতে। তারা রাষ্ট্রভাষার পরিবর্তে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়ার চিন্তা করে। ৮ জানুয়ারি ১৯৫৬ সালের খসড়া শাসনতন্ত্রে এ বিষয়ে প্রস্তাবও করা হয়। আইন পরিষদে ও বাইরে আবারো প্রতিবাদ শুরু হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে খসড়া শাসনতন্ত্রের কৌশলী অবস্থানের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে সে সময়ের উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা চলবে না। বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক।’
রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন গণপরিষদের অধিবেশনে ফরিদপুরের রাজনীতিবিদ আদেল উদ্দিন আহমদ একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তাতে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন তিনি। তার প্রস্তাব গণপরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। একই দিন পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ গণপরিষদে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়। এর ২১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ও বাংলা।’
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দীর্ঘ সংগ্রামের পর প্রাথমিক সফলতা আসে ১৯৫৬ সালে সরকারি স্বীকৃতির মাধ্যমে। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রধান যে মাধ্যম সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার প্রচলনের জন্য ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা কলেজ। তমদ্দুন মজলিসের প্রধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তা।
১৯৬১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সভাপতিত্বে দেশের গুণীজনদের সঙ্গে একটি বৈঠকে বাংলায় উচ্চশিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় একটি বাংলা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলা মাধ্যমে কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। ভাষা আন্দোলনের স্বপ্নের সে কলেজের নাম দেয়া হয় -বাংলা কলেজ। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ সালে খান বাহাদুর আব্দুর রহমান খানের সভাপতিত্বে আরেকটি সভায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, প্রিন্সিপাল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা, সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, কবি ফররুখ আহমদ, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানসহ ৫১সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। যার সেক্রেটারি হন অধ্যাপক আবুল কাসেম।
ডিগ্রি পর্যায়ে তখনো কোনো পাঠ্যবই বাংলায় ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত হয় শিক্ষকগণ নিজ বিষয়ের বক্তব্য বাংলায় লিখে আনবেন এবং তা কলেজের সাইক্লোস্টাইল মেশিনে কপি করে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলি করা হবে। বছর শেষে সেগুলো সমন্বয় করে বই হিসেবে প্রকাশ করা হবে। কলেজ প্রতিষ্ঠায় বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থ সংগ্রহ এবং স্থান নির্বাচন। এজন্য নয় সদস্যের কমিটি করা হয়। চট্টগ্রামেও একটি কমিটি হয়। কলেজের জন্য বাড়ি না পাওয়ায় এক বছর পর ১৯৬২ সালে বকশিবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউটে নাইট কলেজ হিসেবে বাংলা কলেজের যাত্রা হয়। ১৯৬২-৬২ শিক্ষাবর্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা করে বাংলা কলেজ। শুরুর এক বছর কোনো শিক্ষক বেতন নেন নি। কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক আবুল কাসেম টানা আট বছর একটি টাকাও কলেজ থেকে গ্রহণ করেন নি। কলেজের অফিস না থাকায় আজিমপুরে নিজের বাড়ির নিচতলা ছেড়ে দেন, সেখানে বাংলা কলেজের অফিস স্থাপিত হয়। ১৯৬৪ সালে বিএ পরীক্ষায় বাংলা কলেজের শিক্ষার্থীদের ৮৭ দশমিক ৫ ভাগই উত্তীর্ণ হন।
১৯৬৪ সালে মিরপুরে বাংলা কলেজের জন্য জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। সেখানে তখন লোকবসতি ছিল খুবই কম। জঙ্গলে ও খাদে ভরা জায়গাতেই চললো কলেজ স্থাপনের কাজ। ১৯৬৯ সালে মিরপুরে বাংলা কলেজ তার স্থায়ী ক্যাম্পাস উদ্ধোধন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা এই কলেজ দখল করে তাদের ক্যাম্প বানায়। তারা কলেজের নাম বদল করে সাইনবোর্ড টানায়- উর্দু কলেজ। দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে বাংলা কলেজও তার চাপিয়ে দেয়া নাম থেকে মুক্ত হয়।

 

পঞ্চম পর্যায়: একক রাষ্ট্রভাষা
বাংলা ভাষায় পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সে সময়ের গণপরিষদে গৃহীত হয়। পরবর্তীকালে গণপরিষদের নামকরণ হয় জাতীয় সংসদ। এটি কার্যকরের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল, বিজয় দিবসের প্রথম বর্ষপূর্তির দিন। সংবিধানটি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় রচিত হলেও এখানে বলা হয়, কোনো অর্থগত বিরোধ দৃশ্যমান হলে বাংলা রূপকেই অনুসরণ করা হবে। সংবিধানের ৩ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
এই সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১১ এপ্রিল ১৯৭২ সালে সে সময়ের আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। ১৭ এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কমিটি নানা পর্যায়ে মত বিনিময় করে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জনগণের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করা হয় এ সময়। কোনো দেশের জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণে সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি ছিল একটি অসাধারণ ঘটনা। বিভিন্ন পর্যায়ে পাওয়া অসংখ্য মতামত থেকে ৯৮টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়।
গণপরিষদে সংবিধানের খসড়া গৃহীত হয় ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে। কোনো দেশের সংবিধান জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত তা ছাপানো যায় না। এ কারণে প্রথমে খসড়া সংবিধানটি হাতে লিখে তাতে অলঙ্করণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বাংলা সংবিধান পর্যালোচনার জন্য ড. আনিসুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। অপর দুই সদস্য ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান এবং ড. মযহারুল ইসলাম। সংবিধান অলঙ্করণের জন্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে হাশেম খান, জনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায়চৌধুরী ও আবুল বারক আলভীকে নিয়ে শিল্পীদের একটি টিমকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
বাংলাকে শুধু সাংবিধানিক কাগজপত্রে নয়, সর্বস্তরে প্রচলনের উদ্যোগ নেয়া হয় বিভিন্ন সময়। বিদেশে যোগাযোগের বিষয়টি বাদ দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অফিস বা দাপ্তরিক সকল কাজে বাংলা ব্যবহারের প্রথম সরকারি নির্দেশনা জারি হয় ১২ মার্চ ১৯৭৫ সালে। রাষ্ট্রপতির সচিবালয় গণভবন ঢাকা থেকে জারিকৃত এই নির্দেশনার স্মারক নাম্বার ছিল ৭২৯/৯(৪০০)। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জারিকৃত এই আদেশে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে- এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সে অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উশৃঙ্খলা চলতে দেয়া যেতে পারে না। এ আদেশ জারি হওয়ার সাথে সাথে সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা-সরকারি অফিসসমূহে কেবল বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে।’
আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা চলছিল। ব্যক্তিপর্যায়ে কেউ কেউ উদ্যোগও নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়ার পর ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৬ সালে বাংলা ভাষায় ঢাকা হাইকোর্টে একটি ফৌজদারি রিভিশন দাখিলের চেষ্টা করেন অ্যাডভোকেট শামছ্উদ্দিন আহমদ।
আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহারের পাশাপাশি জাতীয় সংসদে সকল আইন বাংলায় প্রণয়নের লক্ষ্যে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সালে একটি বিল আনেন ড. টি আই ফজলে রাব্বী চৌধুরী। সরকারি অফিসে বাংলা ভাষার ব্যবহার না করলে তা অসাদাচরণ বলে নির্দিষ্ট করা হয় এই বিলে। দেড় ঘণ্টা আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে বিলটি পাশ হয়ে পরবর্তীকালে আইনে পরিণত হয়।
‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ শিরোনামের এই আইন অনুসারে বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তা হলে সে আবেদন বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ষষ্ঠ পর্যায়: আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি
বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, সফিউরসহ আরো কয়েকজন। বিস্ময়কর হলো সেই ঘটনার প্রায় পাঁচ দশক পর যে দু’জন ব্যক্তি একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন তাদের নামও ছিল রফিক এবং সালাম!
কানাডা প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ৯ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের সে সময়ের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠার জন্য যে রক্তাক্ত সংগ্রাম হয়েছে তার বর্ণনা তুলে ধরেন। মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের এই অনন্য ঘটনাকে স্মরণ করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার ঘোষণা দিতে অনুরোধ করেন রফিকুল ইসলাম। মাল্টিলিঙ্গুয়াল ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভিং গ্রুপ নামে সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি এই আবেদন করেন। এ সময় জাতিসংঘের কর্মকর্তারা তাকে পরামর্শ দেন বিষয়টি নিয়ে ইউনেস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। একই সঙ্গে তাকে বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ের অনুরোধের চেয়ে কোনো সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেন অনুরোধটি করা হয়।
রফিকুল ইসলাম তার সঙ্গে আরেক উৎসাহী ব্যক্তি আবদুস সালামকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। সংগঠনের নাম কিছুটা বদলে রাখেন মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড। সাত জাতি ও সাত ভাষার দশ জনের স্বাক্ষর নিয়ে ২৯ মার্চ ১৯৯৮ সালে তারা আবার আবেদন করেন ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের।
পাশাপাশি জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের পরামর্শে রফিকুল ইসলাম যোগাযোগ করেন ইউনেস্কোর সাথে। প্রায় এক বছর যোগাযোগের পর ৩ মার্চ ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে রফিকুল ইসলামকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে ইউনেস্কো জানায় তাদের কাছে বিষয়টি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। তারা কোনো সদস্য রাষ্ট্রকে দিয়ে অনুরোধ করতে পরামর্শ দেন।
এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনের তারিখ এগিয়ে আসছিল। রফিকুল ইসলাম এবং তার সঙ্গীরা বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশেও দায়িত্বশীলদের কাছে বিষয়টির তাৎপর্য তুলে ধরেন। সবাই মিলে ২৯টি দেশের সমর্থনের প্রাথমিক আশ্বাসপান। তখন প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সাল ছিল ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সভায় প্রস্তাব উপস্থাপনের শেষ দিন। রফিক, সালামসহ অন্যরা ব্যাপক চেষ্টা করলেও বাংলাদেশ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ তখনো পৌঁছায় নি। এতো অল্প সময়ে এটা আর সম্ভব নাও হতে পারে ভেবে তারা হতাশ হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেক বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি অবহিত হন। সে সময় জাতীয় সংসদের অধিবেশনে উপস্থিত থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে না গিয়ে একক সিদ্ধান্তে জাতীয় সংসদ ভবন থেকেই সরাসরি ইউনেস্কোর কাছে আবেদন পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সাল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। মূল প্রস্তাবক ছিল বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। প্রস্তাবটি সমর্থন করে আইভরি কোস্ট, ইটালি, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ডোমেনিকান রিপাবলিক, ওমান, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপিন্স, বাহামা, বেনিন, বেলারুশ, গাম্বিয়া, কমোরাস, ভানুয়াতু, মাইক্রোনেশিয়া, রুশ ফেডারেশন, লিথুয়ানিয়া, মিশর, সিরিয়া ও হন্ডুরাস। সাধারণ সভায় উপস্থিত ১৮৮ সদস্য রাষ্ট্রের সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি বাঙালিদের পাশাপাশি সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেও মাতৃভাষার প্রিয় দিনে পরিণত হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

One response to “মাতৃভাষা থেকে জাতিরাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি”

  1. Very informative article.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024