শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:১৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-৩৭) রাশিয়াকে সমর্থন এবং শিল্পে চীনের অতিরিক্ত ‘সক্ষমতা’ নিয়ে অভিযোগ ব্লিংকেনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করবে স্যামসাং- গুগল স্মার্ট নেতা হবেন কীভাবে? (পর্ব ৪০) জিআই সনদ পেল টাঙ্গাইল শাড়িসহ আরো ১৪ পণ্য,বাণিজ্য কাঠামো নবায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান জাতির পিতার সমাধিতে বিএসএমএমইউ’র নবনিযুক্ত উপ-উপাচার্যের শ্রদ্ধা নিবেদন তাপদাহের মধ্যে ঢাকা আঞ্চলিক কেন্দ্রে পরীক্ষা নেয়ার দাবি বাউবি’র স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের শেষ হলো চারদিনব্যাপী ন্যাপ এক্সপো ২০২৪ গাজায় মৃত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া শিশুর মৃত্যু প্রাক্তন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট এখন জাপান এয়ারলাইন্সের প্রথম মহিলা বস

ধর্মীয় বৈচিত্র্যের উজ্জ্বল উদাহরণ জাপান

  • Update Time : শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪, ১০.০০ এএম

প্রবীর বিকাশ সরকার

২০০৮ সালে জাপানের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক য়োমিউরি শিম্বুন একটি জরিপে দেখিয়েছে যে, ৭২% জাপানি নাগরিক কোনো ধর্মকেই বিশ্বাস করেন না। নিঃসন্দেহে এই সংবাদ পড়ে আমার মতো অনেকেই অবাক হয়েছেন। অবাক হবারই কথা, কেননা যেদেশে সর্বত্র ধর্মের জয়জয়কার সেদেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্মে বিশ্বাস নেই তা কী করে হয়! জাপানের এমন কোনো শহর, গ্রাম, বন্দর, পাহাড়-পর্বত নেই যেখানে বৌদ্ধ মন্দির এবং শিন্তোও মন্দির চোখে পড়বে না। আড়াই দশক আগেও রাস্তাঘাট, অলিগলিতে ‘ওজিজোাসান’ বা ‘পাথরের দেবমূর্তি’ খুব চোখে পড়ত। মূর্তিগুলোর মাথা ও গলায় লাল সালু কাপড়ের টুকরো বাঁধা থাকত, পায়ের কাছে ধূপকাঠি, ফুল-জল ইত্যাদিও দেখেছি। এখন আর তেমন করে চোখেই পড়ে না।

২০০৬ সালে কলকাতার জনৈক ভিক্ষু বুদ্ধপ্রিয় ভান্তে টোকিওতে এসে অবাক হয়ে বলেছিলেন, “জাপানের মতো এ্যাত বৌদ্ধ মন্দির আর কোথাও দেখিনি! সর্বত্রই দেখছি মন্দির!” শুধু বৌদ্ধ মন্দিরই নয়, শিন্তোও মন্দিরও জাপানের সর্বত্র বিদ্যমান। এগুলোর যেমন ব্যতিক্রম রূপ-নকশা তেমনি পরিবেশগত সৌন্দর্যÑÑবাস্তবিকই উপভোগ করার মতো। আর ধর্মীয় উৎসবগুলো যেমন বিশাল তেমনি ব্যয়বহুল ও আনন্দময়। জাপান ভূখ- সৃষ্টি সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনী কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়, যাতে রয়েছে প্রাচীন ভারতের গভীর প্রভাব।

জাপানে ধর্মীয় বিষয়টি দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অঙ্গ হিসেবে কখনোই দেখা যায় না। নাগরিকরা সাধারণত বছরে মাত্র বারকয়েক মন্দিরে গিয়ে নমঃ নমঃ করেন আর কিছু পয়সা ছুঁড়ে দেন ‘ওসাইছেনবাকো’ বা প্রণামী সংগ্রহবাক্সে। যেমন নববর্ষ, ওবোন উৎসব, শিশুজন্ম, বিয়ে, সৎকার এবং ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষার আগে বা পরে। জাপানের স্থানীয় এবং আদি ধর্ম হচ্ছে ‘শিন্তোও’ যার অর্থ হচ্ছে: ঈশ্বরের পথ। এই ধর্ম মূলত নিরাকার এবং প্রাকৃতিক শক্তিকে ঈশ্বর বা দেবতাজ্ঞানে উপাসনা করা হয়। পূর্বপুরুষরা যা যা রীতি-নীতি, উৎসব, আচার পালন করে গেছেন আজও তার পরিবর্তন ঘটেনি বললেই চলে। অনেকটা সনাতন ধর্মের সঙ্গে মিল রয়েছে। তথাপি, পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম, চীনা তাও এবং কনফুশিয়ান মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে শিন্তোওধর্ম। এই ধর্মের কোনো লিখিত ধর্মগ্রন্থ নেই, নেই দৃশ্যমান দেবদেবীর মূর্তি। কম করে হলেও শিন্তোও ধর্মের ছোটবড় মন্দিরের সংখ্যা এক লাখ। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মন্দির হচ্ছে মিয়ে-ফিপ্রেকচারে অবস্থিত ইসে জিনগুউ। সাধারণত শিন্তোও মন্দির ‘জিনজা’ নামে পরিচিত। বিপুল কিছু শিন্তোও মন্দির বিদ্যমান যেগুলো ‘জিনগুউ’ এবং ‘তাইশা’ নামে পরিচিত।

এদেশের অধিকাংশ মানুষ শিন্তোও ধর্মাবলম্বী কিন্তু জাপান শিন্তোও ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়ÑÑবৌদ্ধ ধর্মীয় দেশ হিসেবেই একে বিশ্বব্যাপী জানে। মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২ খ্রি:) যখন সম্রাট রাজক্ষমতা ফিরে পেলেন সামুরাই-যোদ্ধাদের কাছ থেকে এবং বংশানুক্রমিক শিন্তোও ধর্মাবলম্বী তিনি তাই উক্ত ধর্মও পুনরায় রাষ্ট্রীয় ধর্ম বলে স্বীকৃত হয়েছিল। ইতিহাস অনুযায়ী বার কয়েক রাষ্ট্রীয় ধর্মের অদলবদল ঘটেছে। সম্রাট শিন্তোও ধর্মীয় হলেও তাঁর সময় স্বধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মীয় পবিত্র মন্দির, অমূল্য প্রতœনিদর্শন, চিত্রকলাসমূহ রক্ষা ও সংস্কারের এক মহাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যার নেতৃত্ব দেন তৎকালীন প্রভাবশালী আমলা, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ধনী সামুরাই বংশোদ্ভূত কুকি রিউইচি এবং টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য আমেরিকান অধ্যাপক আর্নেস্ট ফেনোলসা তাঁদের মেধাবী শিষ্য ওকাকুরা তেনশিন। তাঁদের প্রচেষ্টায় রক্ষা পেয়েছে জাপানের বহু বিধ্বস্ত, বিলীয়মান ধর্মীয় প্রতœসম্পদ, যার কয়েকটি আজ বিশ্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ। পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনীষী, লেখক শিল্পাচার্য ওকাকুরা ভারত পর্যন্ত গিয়েছেন ১৯০২ সালে, বৌদ্ধ ধর্মের সন্ধানে, পাঠিয়েছেন তাঁর দু-তিনজন শিষ্যকেও ২০০৩ সালে। কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ওকাকুরা প্রাচীন রাজধানী কিয়োতো মহানগরে একটি ধর্মসম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য, কিন্তু স্বামীজী শারীরিক অসুস্থতার জন্য সে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসভবন এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় দশ মাস ছিলেন তিনি। সখ্য গড়ে উঠেছিল স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভগিনী নিবেদিতা, ধীরামাতা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে। বুদ্ধগয়ায় গিয়েছেন স্বামীজীসহ। ওকাকুরা স্বামীজীর শিকাগো বিশ্ব ধর্মসম্মেলন সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। ১৮৯৩ সালে যখন স্বামীজী আমেরিকা যাচ্ছিলেন মাঝপথে জাপানে দিন দশেক ছিলেন এবং জাপানের ধর্মপ্রাণ আত্মিক সৌন্দর্যবোধে ভীষণ আকৃষ্ট হওয়ার কথা জানা যায় তাঁর শিকাগো ভ্রমণের ব্যবস্থাপক মাদ্রাসার শ্রী আলাশিংগা পেরুমলকে য়োকোহামা বন্দরনগরী থেকে লিখিত চিঠি থেকে। কিন্তু তারও বহু আগে প্রাচীনকালে বৌদ্ধ তীর্থস্থান, শিক্ষাকেন্দ্রদ্বারা সুপরিচিত ভারতবর্ষে যাওয়ার জন্য জাপানি পুরোহিত হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছেন, কেউ কেউ সফল হয়েছেন, কেউ বা মধ্যিপথে স্বর্গবাসী হয়েছেন এমন সংবাদও পাওয়া যায়।

[২] বৌদ্ধ ধর্ম
বৌদ্ধধর্ম এবং জাপান এশিয়ার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। যে ভারতবর্ষ তথাগত বুদ্ধ প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র জন্মস্থান সেখান থেকে তাকে হটিয়ে দিল শাক্ত ব্রাহ্মণ্যধর্ম সেই বিলুপ্তপ্রায় ধর্মটির শেষ আশ্রয়স্থল হলো জাপান। নতুন রূপে, নতুন বিনির্মাণে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হলো।

চিন, কোরিয়া হয়ে মহাযান বৌদ্ধধর্ম জাপানে আগমন করে ৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে। তৎকালীন কোরিয়ার কুদারা রাজ্যের শাসক পায়েকচে বংশের (চধরশপযব, ১৮ খ্রি:পূ:-৬৬০ খ্রি:) রাজা শাক্যমুনির একটি তামার মূর্তি এবং কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থাদি জাপানের সম্রাট কিমমেইকে (৫০৯-৫৭১ খ্রি:) উপহার হিসেবে প্রদান করেন। কিমমেই এই ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি হন। কিন্তু অত সহজে বৌদ্ধধর্মকে রাজ্যে প্রবর্তন করা যায়নি। তখনকার রাষ্ট্রীয় ধর্ম ছিল প্রবল শক্তিশালী শিন্তোও। জাপানের সম্রাট বংশানুক্রমিক শিন্তোও ধর্মাবলম্বী। সম্রাট রাজি হলেও রাজবংশের অন্যান্য এবং শিন্তোও ধর্মীয় পুরোহিত, প-িতরা সম্রাটের অভিপ্রায়ের বিরোধিতা করেন। পরবর্তী শতাব্দীতে এসে সম্রাট কিমমেই-এর পর সিংহাসনে উপবিষ্ট হন বিদাৎসু (৫৩৮-৫৮৫ খ্রি:), তিনি ছিলেন নতুন ধর্মবিরোধী। তাঁর পরে সম্রাট য়োমেই (-৫৮৭ খ্রি:)। তিনিই হচ্ছেন প্রথম জাপানি সম্রাট যিনি বৌদ্ধধর্মের ওপর একনিষ্ঠ আস্থাভাজন ব্যক্তি। তাঁর বংশধর রাজপুত্র শোওতোকু তাইশি (৫৭৩-৬২১ খ্রি:)  হচ্ছেন জাপানে বৌদ্ধধর্মের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। অত্যন্ত প্রভাবশালী এই রাজকুমারের প্রচেষ্টার কারণেই জাপানের সর্বত্র এই ধর্মের প্রসার ঘটে এবং রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গৃহীত হয়। বৌদ্ধধর্মীয় শিক্ষার আলোকে তিনি জাপানের রাজনীতি, সমাজ, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য অশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। এমনকি, জাপানের প্রথম সংবিধান রচনার মূল পরিকল্পকও ছিলেন তিনি। তাঁর আমলে ১৬ ফুট দীর্ঘ তামার বুদ্ধমূর্তিসহ ৪৬টি বৌদ্ধ মন্দির নির্মিত হয়। বৌদ্ধ পুরোহিত এবং সন্ন্যাসিনীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৮১৬ এবং ৫৬৯ জন। তাঁর এই অবদান আজও জাপানিরা নতমস্তকে স্বীকার করেন।

প্রিন্স শোওতোকুর মৃত্যুর পর সম্রাট শোওমু (৭০১-৭৫৬ খ্রি:), যিনি ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ বৌদ্ধÑÑরাজধানী নারা নগরে ‘তোওদাইজি’ নামে কাঠের এক মহামন্দির নির্মাণ এবং তার মধ্যে তামার পাতে গিলটি করা মহাবুদ্ধমূর্তি ‘দাইবুৎসু’, ‘দাইবুৎসু নিয়োরাই’ বা ‘বৈরোচন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটাই বিশ্বের বৃহৎতম বুদ্ধমূর্তি। এই মূর্তির ‘চক্ষু উন্মীলন’ মহানুষ্ঠানের উদ্বোধন করার জন্য দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণকুলে জন্ম মহাভিক্ষু বোধিসেনা (৭০৪-৭৬০ খ্রি:) একাধিক শিষ্যসহ নারায় আগমন করেন ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে। সুদৃশ্যমান এই মন্দিরের প্রাঙ্গণে হরিণ চড়ে বেড়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে মূলত শিন্তোও ধর্মের রীতি অনুসারে।

বৌদ্ধ ধর্ম আগমনের পর প্রথমদিকে বৌদ্ধ ও শিন্তোও ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কিছুকাল অন্তর্দ্বন্দ্ব বিরাজ করলেও একসময় তা মিলেমিশে যায়। মূলত জাপানে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বৌদ্ধ ধর্মের পথ প্রশস্ত হয়। যেমনটি হয়েছে গৌতম বুদ্ধের জীবিতকালে প্রাচীন ভারতে। ভারতবর্ষ থেকে যার উদয় সেই তথাগতের বুদ্ধত্বের শেষ স্থিতি এবং বিকাশ ঘটে জাপানি জাতির আবহমান রীতি-নীতি, সংস্কৃতির প্রবাহ ধরে। তাই ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্ম ও জাপানি বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে আচার-অনুষ্ঠানের অনেক মিল ও তারতম্য বিদ্যমান। কিন্তু জাপানিদের আধ্যাত্মিক শক্তির মূল শিক্ষা এবং মানবিক গুণাগুণ-মূল্যবোধের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এদেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘ওবোন’ উৎসব অন্যতমÑÑতা কয়েক দিনব্যাপী বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়, ব্যয়বহুল আসতবাজি পোড়ানো পূর্বপুরুষদের ধরায় আগমন ও বিদায়কে কেন্দ্র করে। বিশেষ উপাসনা, খাওয়াদাওয়া হয়। থাকে সরকারি ছুটিও। এই রীতিটি ভারতবর্ষে কোনোদিন ছিল না, এখনও নেই।

এটা বলতে হবে যে, জাপানে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা বা দলে বিভক্ত হওয়ার পরেও একমাত্র সামুরাই সেনাশাসকদের কারণে। আসুকা যুগ তথা সপ্তম শতাব্দীতে সম্রাট তেনজি (৬২৬-৬৭১ খ্রি:) প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে অভিজাত যোদ্ধা শ্রেণী গঠন করেন যা ঘটনাক্রমে পরবর্তীকালে কামাকুরা যুগে (১১৮৫-১৩৩৩ খ্রি:)‘সামুরাই’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং একসময় সম্রাটীয় শাসনব্যবস্থা তথা রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করে নিতে সক্ষম হন। তাঁরা ক্রমশ বিভিন্ন গোত্র বা বংশে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ১২ শতাব্দীর দিকে প্রধান তিনটি বংশ ফুজিওয়ারা, মিনামোতো এবং তাইরাÑÑএদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের প্রবল দ্বন্দ্ব-লড়াই দেখা দেয়। ১১৮৫ খ্রিস্টাব্দে মিনামোতো ও তাইরা বংশের মধ্যে এক লড়াই বাঁধে তাতে মিনামোতো বংশপ্রধান য়োরিমোতো (১১৪৭-৯৯ খ্রি:) বিজয়ী হয়ে সূচনা করেন কামাকুরা যুগের। তিনিই প্রথম বাকুফু বা শোওগুন সরকারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রাজধানী হয় কামাকুরা (বর্তমান কানাগাওয়া-প্রিফেকচার) এবং এই বংশের আমলেই নির্মিত হয় তামার তৈরি ‘অমিতাভ’ মহাবুদ্ধমূর্তি, যার উচ্চতা ১৩.৩৫ মিটার এবং ওজন ৯৩ টন। এই যুগে বেশ কিছু যোদ্ধাকৃতির শক্তিশালী কাষ্ঠনির্মিত বুদ্ধমূর্তিও নির্মিত হয়। কামাকুরা যুগে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার জাপানি ইতিহাসে এক বিখ্যাত ঘটনা। ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে মিনামোতো বংশকে পরাজিত করে হোজো বংশ। তাঁরা মিনামোতোদের চেয়েও ছিলেন কট্টর একনায়কতান্ত্রিক। রাজপ্রতিভূর অধিকারী হোজো বংশ প্রধান হোওজোও তোমিকাসা (১১৩৮-১২১৫ খ্রি:) ছিলেন য়োরিমোতোর শ্বশুর। এবং মূল ক্ষমতা ছিল সামুরাই-যোদ্ধা হোওজোওদের হাতেই। মিনামোতো বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ১৬ পুরুষ ধরে হোওজোওরা শাসন করেন কামাকুরা বাকুফু এবং তাঁদের সময়েই উল্লেখযোগ্য তিনটি ইতিহাস সৃষ্টি হয়: প্রথমত, পরাক্রমশালী মঙ্গল সেনাপতি কুবলাই খানের (১২১৫-৯৪ খ্রি:) দুবার জাপান আক্রমণ এবং প্রতিহত করা। দ্বিতীয়ত, ‘জেন্ বৌদ্ধ ধর্মে’র পৃষ্ঠপোষকতা। তৃতীয়ত, ‘বুশিদোও’ (সামুরাই-সংহিতা) রীতি-নীতি-পদ্ধতির প্রসার। বিশেষ করে জেন্ বৌদ্ধ রীতি সামুরাই-যোদ্ধাদের আদর্শ হয়ে উঠেছিল।

জেন্কে জাপানে চিন থেকে নিয়ে আসেন বৌদ্ধ পুরোহিত মিয়োআন এইসাই (১১৪১-১২১৫ খ্রি:), যিনি জাপানে রিনজাই   বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবর্তক, যদিও মূল প্রবর্তক চিনের খল্পহলল্ড ণল্ডীঁপ্সহ (-৮৬৬ খ্রি:) তাঁর নামানুসারেই এই রিনজাই। তারপর চিন থেকে শিক্ষা নিয়ে আর একজন পুরোহিত দোওগেন জেনজি (১২০০-৫৩ খ্রি), জেন্ সোওতোওশুউ সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও তিনি কিছুদিন এইসাইয়ের শিষ্য ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, লিনজি ছিলেন প্রথম জেন্ প্রবর্তকের অনুসারী। যাহোক, হোওজোও সামুরাইরা এই নতুন ধারণাকে উৎসুকভরে স্বাগত জানিয়েছিলেন তাঁদের শাসনামল ১৩ শতকে।

জেন্ বৌদ্ধ ধর্ম এবং জাপান আজ একে অপরের সম্পূরক। ‘জেন’্ হচ্ছে ‘ধ্যান্’ (সংস্কৃত ধ্যান্, ইংরেজি মেডিটেশন)। এর  মাধ্যমে নিজের মনের প্রশান্তিকে অন্বেষণ করা এবং বুদ্ধত্বে সমাধিস্থ হওয়াই জেন্ এর মূল লক্ষ্য। জেন্ বৌদ্ধ ধর্মের মূল প্রবর্তক হচ্ছেন বোধিধর্ম। যদিওবা গৌতমবুদ্ধ নিজে খ্রি:পূর্ব ৫০০ শতাব্দী তথা ২৫০০ বছর পূর্বে এর সূচনা করেছিলেন বুদ্ধগয়ায় নির্বাক ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছিলেন বুদ্ধত্ব বা সেই জ্ঞানালোক যা কিনা মানবমুক্তির সার্বিক পন্থা। এই বোধিধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না, মনে করা হয় তিনি দক্ষিণ ভারতের পল্লব রাজবংশীয় (৭-৮ খ্রি:) এক রাজপুত্র। মূলত দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর উত্তরপুরুষ ও রাজপুত্র বোধিধর্ম ছিলেন দীর্ঘকায় সুঠাম দেহের অধিকারী এবং বদমেজাজি মানুষ। বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ঘুরে ঘুরে অবশেষে চিনে গিয়ে মূল বৌদ্ধ ধর্মের এই ধ্যান্-সাধনা তথা শিক্ষাটিকে চিনা বৌদ্ধ ধর্মের অঙ্গীভূত করে জনপ্রিয় করে তোলেন। চিনা ভাষায় ‘জেন্’কে ‘চ্যান্’ বলা হয়। জাপানি ভাষায় বোধিধর্মকে বলা হয় ‘দারুমা’। দারুমার জেন্ সম্প্রদায় জাপানে জন্ম দেয় বিগত ৬শ বছরের মধ্যে অভূতপূর্ব এক আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের। তার প্রমাণ আজও আমরা দেখি এই জাপানেই শুধু জেন্ মন্দিরে নিয়মিত অনুষ্ঠিত এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘জাজেন্’ বা ‘ধ্যানাসন’ এর মধ্যে। অত্যন্ত কঠোর এই ‘ধ্যান্’ পদ্ধতি, যা সকাল-বিকেল শুধু জেন্ পুরোহিতই নন, দেশি-বিদেশি সাধারণ মানুষেরও এই ধ্যানাসনে অংশগ্রহণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ রয়েছে।

জেন্ মানেই জাপানের বহুমাত্রিক সৌন্দর্যের আবিষ্কার। শত শত বছর ধরে গড়ে উঠেছে জেন্ সাহিত্যচর্চাÑÑনিয়মিত পুরোহিতরা তো চর্চা করেনই, পাশাপাশি শিক্ষা প্রদান করেন মন্দিরের মধ্যেই হাইকু, তান্কা, ওয়াকা প্রভৃতি কবিতা যাঁরা আগ্রহী তাঁদেরকে; জেন্ কলাচর্চা একটি ব্যতিক্রমধর্মী অনুষদ জেন্ বৌদ্ধ ধর্মে। অতীতে চিনে যেমন হয়েছে কিন্তু সে হারিয়ে গেছে, কিন্তু আজও জাপানে এই চর্চা অব্যাহত। চিনের ইতিহাসকে অনেক আগেই ছাপিয়ে গেছে জাপানি  জেন্চিত্রচর্চা ‘সুইবোকুগা’ বা ‘কালো কালির অঙ্কনচিত্র।’ এই রীতিতে সিল্ক কাপড় এবং হস্তনির্মিত ওয়াশিপেপারে কালো রঙে ছবি আঁকা হয়ে থাকে। শুধু চিত্র আঁকাই নয় ‘শোদোও’ বা ‘লিপিচর্চা’ জাপানি জেন্ বৌদ্ধ ধর্মকে একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যে উন্নীত করেছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিনে ও জাপানে এর দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং ক্ষুদ্র কবিতা বা স্বাক্ষর এই রীতিতে লিখে ভক্তদেরকে উপহার দিয়েছেন। জেন্ থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে ‘চাদোও’, ‘সাদোও’ বা ‘(গ্রিন টি সিরেমনি’ এবং ফুলসজ্জা ‘ইকেবানা’। অসাধারণ এই জেন্ সংস্কৃতি সামুরাই শ্রেণী ছাড়াও ধনী ব্যবসায়ীরাও বহুবছর ধরে পৃষ্টপোষকতা করেছেন। মেইজি মহাসংস্কারের পর আধুনিক জাপানে এর চর্চা বা পৃষ্ঠপোষকতা ছিল একটি সামাজিক মর্যাদাস্বরূপ। আজকে বিশ্বব্যাপী এদুটো জেন্ সংস্কৃতি প্রভূত সুনাম অর্জন করে চলেছে। অবশ্য কালক্রমে জাপানের অন্যান্য সংস্কৃতিতেও জেন্ প্রভাব পড়েছে যেমন নোহ্ থিয়েটার, বুনরাকু (পুতুল নাচ); বোনসাই, বাগানচর্চা, জুদোও, কারাতে, কেনদোও, কিউদোও প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মোটকথা, আজকের জাপানে জেন্ বৌদ্ধ ধর্ম আন্তর্জাতিক মৈত্রীবন্ধনের ক্ষেত্রেও অপরিসীম প্রভাব রেখে চলেছেÑÑআপন স্বরূপে উদ্ভাসিত পারস্পরিক সহনশীলতা ও প্রশংসাবোধ। এখানেই মনে হয় পার্থিব ধর্ম দিয়ে কী হবে যদি তার পরিশীলিত সংস্কৃতি না থাকে? তাই হয়ত জাপানিরা ধর্মের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন সংস্কৃতিকে।

[৩] খ্রিস্টান ধর্ম
জাপানের তৃতীয় প্রধান ধর্ম খ্রিস্টান। খ্রিস্টান ধর্মীয় চিন্তাচেতনা জাপানকে আধুনিক করেছে নিঃসন্দেহে। নতুন ও নতুত্বের প্রতি অদম্য কৌতূহলী করেছে পাশ্চাত্যের এই ধর্মটি। ১৫৪৯ সালে ভারত থেকে খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে আসেন জাপানে প্রথম জেসুইট পাদ্রী ফ্রান্সিস জেভিয়ার (ঝধরহঃ ঋৎধহপরং ড়ভ ঢধারবৎ, ১৫০৬-৫২ খ্রি:)। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় দ্বীপ কাগোশিমা থেকে তিনি ক্যাথলিক ধর্মশিক্ষা প্রচার শুরু করেন জাপানে। তবে বেশিদিন তিনি থাকেননি এদেশে মাত্র দুবছর কিন্তু এর মধ্যেই তাঁর শিষ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় জেসুইট সম্প্রদায়। তিনি ফিরে যান পর্তুগিজ অধ্যুষিত ভারতের গোয়া দ্বীপে ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর এই অভিযানে তাঁকে প্রভূত সহযোগিতা করেন ‘আনজিরোও’ নামক একজন স্থানীয় জাপানি নাগরিক, জেভিয়ারের দোভাষীও ছিলেন তিনি। জানা যায় যে, ১৭ শতাব্দীর প্রথম দিকে জাপানব্যাপী ৭৫০,০০০ জন জাপানি খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন! ক্রমশ এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলেও প্রবল বাধা-বিপত্তির মুখে পড়ে এই নতুন ধর্ম। বিশেষ করে, এদো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮ খ্রি:) এসে চরম সরকারি বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। ১৬১৩ খিস্টাব্দে বিদেশি মিশনারিদেরকে জাপান থেকে বিতাড়িত করে শোওগুন তোকুগাওয়া সামুরাই সরকার। দারুণ অমানবিক অবস্থার মধ্যে খ্রিস্টানরা তাঁদের কর্মকর্ম পালন করতে থাকেন। এই দুুঃসহ দুর্দিনের কালো মেঘ সরে যেতে থাকে যখন মার্কিন নৌসেনা প্রধান কমোডর ম্যাথু প্যারি (১৭৯৪-১৮৫৮ খ্রি:) ১৮৫৩ খিস্টাব্দে জাপানের উরাগা সমুদ্রবন্দরে কালো জাহাজ নোঙর করে জাপানকে বহির্বিশ্ব তথা আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য উন্মুক্ত হতে নির্দেশ দেন।

আমরা অনেকেই জানি যে, দুশ বছরের জন্য জাপান ছিল প্রায় সম্পূর্ণভাবে বহির্বিশ্ব থেকে স্ববিচ্ছিন্ন একটি দেশ। কমোডর প্যারির এই হাঁক-ডাক, যুদ্ধের হুমকি প্রদর্শন এবং আধুনিক বিশ্বের প্রতি একদল প্রভাবশালী উচ্চবিলাসী জাপানি ব্যক্তিদের প্রবল আগ্রহ জাপানকে উন্মুক্ত এবং জাপানে খ্রিস্টান ধর্মের জোয়ার সৃষ্টি করে। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ থেকেই জাপানে আমেরিকা থেকে প্রোটেস্টান্ট মিশনারি, ক্যাথলিক, রাশিয়ান অর্থডক্স খ্রিস্টান প্রচারকরা আসতে শুরু করেন এবং ধর্মপ্রচার করতে থাকেন সক্রিয়ভাবে। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেইজি সম্রাটকে কেন্দ্র করে যে মহাসংস্কার সংঘটিত হয় তাতে রাজকীয় ক্ষমতার পুনরুদ্ধার ঘটে এবং শিন্তোও ধর্মও রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রাষ্ট্র উন্মুক্ত এবং শিন্তোও ধর্মের উদার নীতি বলবৎ থাকা সত্ত্বেও বিদেশি ধর্মপ্রচারকরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি দলনেরও শিকার হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায় মেইজি যুগেই (১৮৬৮-১৯১২ খ্রি:)।

পরবর্তীকালে অবশ্য আধুনিক শিক্ষার আলোকে ধর্মীয় বাধা-নিষেধ ক্রমশ দূরীভূত হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন খ্রিস্টান ধর্মীয় সুশিক্ষিত পাশ্চাত্যবাসী যাঁরা এদেশে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাঁদের কাছে শিক্ষালাভ করে অনেক জাপানি নাগরিক আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান, নেদারল্যান্ডসে উচ্চশিক্ষার্থে গমন এবং ফিরে এসে স্বদেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। হঠাৎ করে আধুনিক সংস্কৃতি যেমন গ্রামীণ জাপানকে দ্রুত পরিবর্তিত করতে থাকে তেমনি পুরনো সামাজিক রীতি-নীতি, বিশ্বাস, কুসংস্কারেও বিবর্তনের আলো ফেলতে থাকে সমানভাবে। খ্রিস্টান ধর্মীয় চার্চ যেমন স্থাপিত হতে থাকে সেইসঙ্গে গড়ে উঠতে থাকে উদারনৈতিক, মুক্তচিন্তাবলম্বী ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেমন, জাপানের প্রথম মহিলা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিহোন জোশি দাইগাকু বা জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী শিক্ষাবিদ ডঃ নারুসে জিনজোও (১৮৫৮-১৯১৯ খ্রি:)। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাপানে এবং নাগানো-প্রিফেকচারে অবস্থিত ওই মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখায় আমন্ত্রিত হয়ে কবিগুরু কিছুদিন অতিথি ছিলেন, বক্তৃতা দিয়েছিলেন ছাত্রী সমাবেশে।

মেইজি যুগে পাশ্চাত্য শিক্ষার আমদানি এই যুগের জাপানি সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন বলতেই হয়, যা থেকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপনিবেশ ভারতবর্ষ বরাবরই হয়েছিল উপেক্ষিত। বৃটিশ কিছু সংখ্যক ভারতীয়কে শিক্ষা দিয়েছিল তাদের চিরকালের গোলাম করে রাখার জন্য, সার্বিক উন্নয়নের জন্য নয়। বস্তুত, জাপান খ্রিস্টানদের আধুনিক বিদ্যাশিক্ষাকে শক্তিশালী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে কাজে লাগিয়েছিল পুরো মাত্রায়। রবীন্দ্রনাথ জাপানের এই পাশ্চাত্যকরণকে প্রসন্নদৃষ্টিতে দেখেননি, পাঁচবার জাপানে এসে প্রত্যেকবারই সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এটা ঠিক যে, জাপান প্রাচীনকাল থেকেই বহির্বিশ্বের সম্ভাবনাময় সংস্কৃতি-সভ্যতাকে নিজের সংস্কৃতি-রীতি-নীতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে আত্মস্থ করে নিয়েছে। নিজের ভবিষ্যৎ নির্মাণে ব্যাপ্ত থেকেছে। ধর্মের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আদির সঙ্গে নতুনের মৈত্রীবন্ধনের পৌরহিত্যে শতভাগ সফল হয়েছে ক্রমাগত সংস্কারÑÑগ্রহণবর্জনের মধ্য দিয়ে। যা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে স্বাধীন ভারতÑÑসংবিধানে ‘ধর্মনিরেপেক্ষ’ নীতিকে গ্রহণ করেও। জাতীয় পতাকায় বৌদ্ধ ধর্মীয় ‘ধর্মচক্র’কে রেখে বৌদ্ধ ধর্মকেই বিলুপ্ত করে দিয়েছে ভারতভূমি থেকে সনাতনী ধর্মীয় নেতারা এবং তাঁদেরই কারসাজির ফলাফল ভারতভাগ তথা বাংলা ভাগ। তাঁরা কোনো ধর্মীয় সমন্বয়, সহাবস্থান ঘটাতে পারেননি আজ পর্যন্ত। তাহলে কী অর্থ দাঁড়ায় এই ধর্মচক্রকে বাতাসে উড়িয়ে?

অথচ, এটা আজ স্বীকার করতেই হবে যে, বর্ণাঢ্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মতো ধর্মীয় সহাবস্থান বা উদার মনোভাবসম্পন্ন ধারা যা জাপানে মেইজি যুগে সূচিত হয়েছিল তা এখনও বিদ্যমান। এবং জাপান এর জন্য অহঙ্কার করতেই পারে। বিগত দেড়শ বছরের মধ্যে এই দেশে বহু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা, ফাউন্ডেশন, সংগঠন স্থাপিত হয়েছে, এর মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় একটি চমৎকার উদাহরণ। সোফিয়া বা টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়, রিক্কিয়োও বিশ্ববিদ্যালয়, সেইতোকু বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতিও উল্লেখযোগ্য খ্রিস্টান উচ্চবিদ্যাপীঠ। শিন্তোও ধর্মীয়, বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় তো একাধিক আছেই। অবশ্য এগুলোতে শুধু যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয় তা কিন্তু নয়। সাধারণ, বিভিন্ন বিষয়াদির অনুষদ বর্তমান। যেমন মানবিক, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, বাণিজ্য, ব্যবহারিক বিজ্ঞান, শিল্পকলা প্রভৃতি। এবং বলা নি®প্রয়োজন এগুলো পরিচালিত হচ্ছে আধুনিক, উদারনৈতিক শিক্ষানীতি দ্বারা, যে কারণে ক্যাম্পাসের অনুকূল পরিবেশ এবং বাস্তবতা তরুণ জাপানি প্রজন্মকে ধর্মীয় প্রতিযোগিতা, ধর্মকে পণ্যায়ন করা, ধর্ম নিয়ে ব্যবসা বা রাজনীতি করার মতো কলুষতা থেকে বিরত রেখেছে।

এদো যুগে যেমন খ্রিস্টান ধর্মকে অবৈধ ঘোষণা করে জাপানি ও বিদেশি খ্রিস্টানদেরকে অত্যাচার করা হয়েছে বা সম্রাট বংশানুক্রমিকভাবে আদিধর্ম শিন্তোও ধর্মাবলম্বী বলে মেইজি যুগ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত শিন্তোও ছিল পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রধর্ম তেমনটি এখন আর নেই। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সংবিধানের ২০ ধারায় বলা হয়েছে: ঋৎববফড়স ড়ভ ৎবষরমরড়হ রং মঁধৎধহঃববফ ঃড় ধষষ. ঘড় ৎবষরমরড়ঁং ড়ৎমধহরুধঃরড়হ ংযধষষ ৎবপবরাব ধহু ঢ়ৎরারষবমবং ভৎড়স ঃযব ঝঃধঃব, হড়ৎ বীবৎপরংব ধহু ঢ়ড়ষরঃরপধষ ধঁঃযড়ৎরঃু. তবে এই বিধান লিখিত না হলেও মেইজি যুগেই সনাতন ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম প্রভৃতি ধর্মের প্রভাব পড়েছে শিন্তোও ধর্মের ওপর, ফলে উনিশ শতকের দিকে এটি উদারনৈতিক ধর্ম হিসেবে আদর্শায়িত হয়েছে। শক্তিশালী রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে শান্তি ও সমন্বয় জরুরি এটা সুশিক্ষিত মেইজি রাষ্ট্রনায়ক এবং বুদ্ধিজীবীরা সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন। তারই বাস্তব এবং চমৎকার প্রতিফলন ঘটেছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর জীবনে। ফলে ধর্মীয় স্বাধীনতা জাপানের মতো আর কোনো দেশেই এতখানি দেখা যায় না। আশ্চর্য যে, জীবিতকালে জাপানিদের মধ্যে চমৎকার এক ধর্মীয় সমন্বয় বা ঐকতান লক্ষ করা যায়। বিয়ের মন্ত্রপাঠ শিন্তোও ধর্ম অনুসারে, অতিথি আপ্যায়ন খ্রিস্টীয় রীতিতে আর মৃত্যুর পর দাহ হয় বৌদ্ধ ধর্মানুসারে। এই যে ধর্মীয় সহাবস্থান, সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এর চেয়ে শিক্ষামূলক অধ্যায় মানুষের জীবনে আর কী হতে পারে? উপমহাদেশ এই উদাহরণ আজও স্থাপন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।

[৪] ধর্ম ও প্রকৃতি
প্রধানত তিনটি যুগকে কেন্দ্র করে জাপানে বৌদ্ধধর্মের একাধিক সম্প্রদায় বা স্কুল জন্ম নিয়েছে। এই তিনটি যুগ হচ্ছে নারা যুগ (৭১০-৭৪৮ খ্রি:), হেইয়ান যুগ (৭৯৪-১১৮৫ খ্রি:) এবং কামাকুরা যুগ (১১৮৫-১৩৩৩ খ্রি:)। অবশ্য পরবর্তীকালেও একাধিক সম্প্রদায়, নওধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে। বর্তমানে জাপানে ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো হচ্ছে কেগেনশুউ, রিৎসুশুউ, দেনদাইশুউ, শিনগোন্শুউ, জোদোশুউ, জোদোশিন্শুউ, জিশুউ, ইউজু নেম্বুৎসুশুউ, নিচিরেন্শুউ এবং তিনটি জেন্ সম্প্রদায়ÑÑরিনজাই, সোওতোও এবং ওবাকু।

মেইজি যুগে আরও দুটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্মকথা জানা যায় যথাক্রমে রেইয়ুউকাই ও শিন্নিয়োএন। চিন্তার ভিন্নতা থেকে এদো যুগের শেষ দিক থেকে শুরু করে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মূল বৌদ্ধ ধর্ম থেকে আলাদা হয়ে আরও একাধিক শাখা শিন্তোও ধর্মের প্রভাবে সম্প্রদায় বা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলোর কোনো কোনোটাকে কর্মতৎপরতার ভিত্তিতে নওধর্মও বলা যায় যেমন, তেনরিকিয়োও, কুরোজুমিকিয়োও, কোনকোকিয়োও, ওমোতোকিয়োও, সেইচোনোইয়ে, সেকাই কিউসেইকিয়োও, রিশ্শোকোসেকাই, সোকা গাক্কাই, ঔম শিনরিকিয়োও, কিরিইয়ামা মিক্কিয়োও, আগোনশুউ, সেকাই কিউসেইকিয়োও, তেনশো কোতাই জিন্গুকিয়োও, কোওফুকু নো কাগাকু প্রভৃতি।

একথা বিবেচনাযোগ্য যে, শিন্তোও ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জাপানি নাগরিকদের মধ্যে সামান্যতম আধিপত্যবাদী চিন্তাভাবনা আজ আর নেই। বরং শিন্তোও ধর্মের সহনশীল উদার নীতির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের অনুপ্রবেশ বা সমাবেশ ঘটেছে জাপানে এটা নিঃসন্দেহে আধুনিক জাপানের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বৈচিত্র্যকেই নির্দেশ করে। জাপানে আগত একেবারে নতুন ধর্মটি হচ্ছে ইসলাম ধর্ম। ১৯০৯ সালে মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি শাখা বাহাই জাপানে প্রথম সাধারণসভার আয়োজন করে তাতে ভারতীয় সনাতন ধর্ম, আমেরিকান খ্রিস্টান এবং জাপানি বৌদ্ধরাও উপস্থিত ছিলেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান সফরে এলে পরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাপানস্থ বাহাইপ্রধান মিস অ্যাগনেস বি.আলেকসান্ডার (১৮৭৫-১৯৭১ খ্রি:) এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে শিন্তোওপন্থী তাইশোও সম্রাট য়োশিহিতো (১৮৭৯-১৯২৬ খ্রি:) মিস আলেকসান্ডারকে রাজপ্রাসাদে সাকুরা উৎসবে আমন্ত্রণ জানান। কথিত অছে যে, বাহাই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ইরানে জন্ম বাহাউল্লাহ্র (১৮১৭-৯২ খ্রি:) সাথে রবীন্দ্রনাথের আমেরিকায় এবং তাঁর এক শিষ্যের সঙ্গে হংকং-এ একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। কবি বাহাই সম্প্রদায় সম্পর্কে জানতেন। তাইশোও যুগ (১৯১২-২৬ খ্রি:) এবং শোওয়া যুগের (১৯২৬-৮৯ খ্রি:) প্রথম দিকে একাধিক তুর্কী মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা জাপানে আগমন করেন সহযোগিতা পাওয়ার লক্ষ্যে। তৎকালীন প্রভাবশালী গুপ্ত রাজনৈতিক সমিতি ‘গেন্য়োওশা’ প্রধান গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু (১৮৫৫-১৯৪৪ খ্রি:) প্রমুখ তাঁদেরকে সথাসম্ভব সহযোগিতা করেন। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী নেতা এবং শিন্তোও ধর্মাবলম্বী। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কোবে বন্দরনগরীতে প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক পরে রাজধানী টোকিওতে। বর্তমানে ইসলাম ধর্মাবলম্বী জাপানি নাগরিক কয়েক ৬ লাখের বেশি।

১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে নিপ্পন বেদান্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় গানাগাওয়া-প্রিফেকচারে। একটি ব্যাপার লক্ষণীয় যে, বৌদ্ধ দেবদেবী হিসেবে পূজিত হচ্ছে এদেশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, ইন্দ্র, শিব, কুবের প্রভৃতি যাঁরা লোকজশক্তির দেবদেবী হিসেবে সনাতন ধর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত। দুধরনের বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে এদেশে একটি ‘জি’ বা ‘ওতেরা‘ অন্যটি ‘তেন্।’ যেমন কিচিজোও-জি অর্থাৎ লক্ষ্মীর মন্দির। তাইশাকু-তেন্ ইন্দ্রের মন্দির। দাইকোকু-তেন্ শিবের মন্দির, বেনজাই-তেন্ সরস্বতীর মন্দির। আবার জাপানি বিভিন্ন ধর্মকে চিনা তাও, কনফুশিয়ান মতবাদও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে ফলে চিনা দেবদেবীও পূজিত হচ্ছে। জাপানি, ভারতীয় ও চিনাসহ সাতজন দেবদেবীর একটি কল্যাণদায়ী দল যার নাম ‘শিচিফুকুশিন’ খুবই বিখ্যাত জাপানে।

তবে যে জিনিসটি জাপানে সহজেই লক্ষণীয় এবং ব্যতিক্রম তাহল, ধর্মীয়বোধের সঙ্গে প্রকৃতির একটি নিবিড় সম্প্রীতি। যা জাপানকে বিশ্বের বুকে মহান একটি রাষ্ট্রের মর্যাদায় আসীন করেছে। যেকোনো শিন্তোও মন্দিরের প্রাঙ্গনে জীবজন্তুর মূর্তি সসম্মানে স্থাপিত। যেমন গাভী, ষাঁঢ়, শেয়াল, হরিণ, পেঁচা, বানর প্রভৃতি যা দেখে মনে হয় ইকোলজি বা বাস্তব্যবাদের প্রতীকও বুঝিবা জাপানের নিজস্ব শিন্তোও ধর্মটি।

* ২০০৬ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় জাপানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকসংখ্যা যথাক্রমে: শিন্তোও ১০৬,৮১৭,৬৬৯ (৫১.১%); বৌদ্ধ ৮৯,১১৭,৭৬৯ (৪২.৭%); খ্রিস্টান ৩,০৩২,২৩৯ (১.৫%); অন্যান্য ৯,৮১৭,৭৫২ (৪.৭%)।

আলোকচিত্র:
০১ একটি শিন্তোও মন্দির
০২ শিন্তোও দেবতারূপী শেয়াল
০৩ দাই বুৎসু বা মহাবৌদ্ধমূর্তি
০৪ জাপানি সরস্বতীদেবী
০৫ খ্রিস্টানদের মেরিক্রিসমাস
০৬ একজন ধর্মপ্রাণ জাপানি মুসলি

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024