একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নিরাপত্তাহীনতার কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিমধ্যেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পোশাকে, সাদাপোশাকে ও গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করা হয়েছে। সেই সঙ্গে নাশকতা ও উসকানিমূলক পোস্ট করা বা শেয়ার করতে না পারে, তার জন্য অনলাইনেও করা হচ্ছে নজরদারি।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে তিন স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা ও এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পক্ষ থেকে সারা দেশে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সেই সঙ্গে রাজধানীর প্রধান প্রধান প্রবেশপথ কঠোর নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে। সন্দেহভাজন যানবাহন ও ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হচ্ছে। এ ছাড়াও সারা দেশের শহীদ মিনারকেন্দ্রিক এলাকায় করা হচ্ছে ব্যাপক নজরদারি।
সরেজমিনে শাহবাগের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, সব ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শাহবাগকে নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), র্যাবসহ নানান গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা লক্ষ করা যায়। সেই সঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পোশাকের পাশাপাশি সাদাপোশাকেও নজরদারি করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকায় চলাচলের জন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে দিকনির্দেশনা।
শাহবাগ থানার ওসি মামুন অর রশিদ সারাক্ষণকে বলেন, ‘শহীদ মিনার এলাকায় নিরাপত্তার জন্য আমরা কাজ করছি। বর্তমানে এখানেই রয়েছি।’
একুশে ফেব্রুয়ারির নিরাপত্তা প্রসঙ্গে র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সারাক্ষণকে বলেন, ‘মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কোনো ধরনের জঙ্গি হামলা ও নাশকতার তথ্য আমাদের কাছে নেই। একুশে ফেব্রুয়ারির নিরাপত্তায় আমরা সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছি।'
লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, কেউ যেন কোনো ধরনের নাশকতা ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সে জন্য তিনটি স্তরে কাজ করবে র্যাব। প্রাথমিক পর্যায়ে র্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়ন সারা দেশে সাদাপোশাকে নজরদারি বৃদ্ধি করবে। এর পাশাপাশি পোশাকধারী সদস্যদের সরব উপস্থিতি ও টহল থাকবে।
লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আরো বলেন, মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ইতোমধ্যেই সাইবার মনিটরিং করা হচ্ছে। সাইবারকেন্দ্রিক কোনো ধরনের অপ্রীতিকর বা নাশকতামূলক পোস্ট যেন কেউ শেয়ার করতে না পারে, কেউ যেন উসকানিমূলক কোনো ধরনের বক্তব্য দিতে না পারে, সে বিষয়ে র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম অত্যন্ত সতর্ক রয়েছে।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ শুরু করেছি। শনিবার সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনবল মোতায়েন থাকবে।’
আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আমরা দেশের জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই, নিরাপত্তাহীনতার কোনো আশঙ্কা নেই। র্যাব তাদের পাশে আছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা র্যাবকে পাশে পাবে। আমরা সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেস, একটি বার্তা দিতে চাই- দেশের জনগণ যেন নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় না ভোগেন, সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে র্যাব।’
এ ছাড়াও তিনি বলেন, ঢাকার জাতীয় শহীদ মিনার এলাকায় ডগ স্কোয়াড টিম, বোম ডিসপোজাল টিম, ড্রোন, মাইন সুইপিং টিম থাকবে।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ দিবসকে ঘিরে কোনো সুনির্দিষ্ট হুমকি নেই। তবু জঙ্গি কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি করা হবে।’
পুলিশ কমিশনার বলেন, দল পর্যায়ে সর্বোচ্চ পাঁচজন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে একসঙ্গে দুজনের বেশি প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। মাস্ক ছাড়া একজনও শহীদ মিনারে প্রবেশ করতে পারবেন না।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, এবার তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সদস্যরাও থাকবেন।
শহীদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি করা হবে। এ জন্য ডিএমপি কন্ট্রোল রুম থেকে তা মনিটরিং করা হবে। পাশাপাশি বোম ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াটসহ অন্য ইউনিটগুলো সক্রিয় থাকবে বলেও জানান তিনি।
শফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহীদ মিনার এলাকায় যান চলাচল বরাবরের মতো নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
তিনি বলেন, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে আমরা এবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করতে যাচ্ছি। চারদিকে করোনা পরিস্থিতি, ভ্যাকসিনেশন চলছে, তাতে ভীতি রয়েছে। যে কারণে এবার রাজনৈতিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫ জন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে দুজনের বেশি একসঙ্গে শহীদ মিনারে না আসার অনুরোধ করা হচ্ছে।'
শহীদ দিবসকে ঘিরে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম নজরদারি রাখা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘সাধারণত এ ধরনের দিবসগুলো উপলক্ষে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ছোট ঘটনা ঘটিয়ে হলেও দৃষ্টি আকর্ষণের একটা চেষ্টা থাকে। শহীদ দিবস বাঙালির আবেগের একটি বড় জায়গা। এখানে ছোট্ট একটি ঘটনা ঘটাতে পারলেও আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। জঙ্গি কার্যক্রম বা গতিবিধি নজরদারির জন্য আমাদের সাইবার ইউনিটগুলো সক্রিয় রয়েছে। আমাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি আছে। আমরা মনে করি না এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটার সাহস তারা পাবে।’
এদিকে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস '২১ ফেব্রুয়ারি' যথাযথ ও সুশৃঙ্খলভাবে পালন করার জন্য শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ২টা পর্যন্ত জনসাধারণের চলাচল ও সব ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নরূপ ট্রাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রবেশের রাস্তা
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রবেশের ক্ষেত্রে সকল সম্মানিত নাগরিকবৃন্দকে পলাশী ক্রসিং, এসএম হল এবং জগন্নাথ হলের সামনের রাস্তা দিয়ে শহীদ মিনারে প্রবেশ করতে অনুরোধ করা হলো। কোনো ক্রমেই অন্য কোনো রাস্তা ব্যবহার করে শহীদ মিনারে প্রবেশ করা যাবে না।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বের হওয়ার রাস্তা
শহীদ মিনার দিয়ে বের হওয়ার ক্ষেত্রে দোয়েল চত্বরের দিকের রাস্তা অথবা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে বের হতে পারবেন। কোনোক্রমেই প্রবেশের রাস্তা দিয়ে বের হওয়া যাবে না।
যেসব রাস্তা বন্ধ থাকবে
বকশীবাজার-জগন্নাথ হল ক্রসিং সড়ক, চাঁনখারপুল-রোমানা চত্বর ক্রসিং সড়ক, টিএসসি-শিববাড়ী মোড় ক্রসিং ও উপাচার্য ভবন-ভাস্কর্য ক্রসিং (ফুলার রোড) রাস্তা বন্ধ থাকবে।
ডাইভারশন ব্যবস্থা
ক. শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ৬টা থেকে শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা পর্যন্ত রাস্তায় আলপনা অঙ্কনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আশপাশের রাস্তা বন্ধ থাকবে। এ সময় শিববাড়ী, জগন্নাথ হল ও রোমানা চত্বর ক্রসিংগুলোতে গাড়ি ডাইভারশন দেয়া হবে।
খ. শনিবার ( ২০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ২টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যত্রতত্র অনুপ্রবেশ বন্ধের লক্ষ্যে নীলক্ষেত, পলাশী মোড়, ফুলার রোড, বকশীবাজার, চাঁনখারপুর, শহিদুল্লাহ হল, দোয়েল চত্বর, জিমনেসিয়াম, রোমানা চত্বর, হাইকোর্ট, টিএসসি, শাহবাগ ইন্টারসেকশনসমূহে রোড ব্লক দিয়ে গাড়ি ডাইভারশন দেয়া হবে।
গ. রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৫টায় সায়েন্সল্যাব থেকে নিউমার্কেট ক্রসিং, কাঁটাবন ক্রসিং হতে নীলক্ষেত ক্রসিং এবং ফুলবাড়িয়া ক্রসিং হতে চাঁনখারপুল ক্রসিং পর্যন্ত প্রভাতফেরি উপলক্ষে সব ধরনের যাত্রীবাহী গাড়ি প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে।
গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা
ক. একুশের প্রথম প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়াম মাঠে ভিআইপি গাড়িসমূহের পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
খ. নগরবাসীরা নীলক্ষেত-পলাশী, পলাশী-ঢাকেশ্বরী সড়কসমূহে তাদের গাড়ি পার্কিং করতে পারবেন।
ডিএমপির সাধারণ নির্দেশনাবলি
ক. বর্তমান করোনা অতিমারি পরিস্থিতিতে কবরস্থান এবং শহীদ মিনারে যারা শ্রদ্ধার্ঘ্য ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন, তাদের মাস্ক পরিধান করতে হবে।
খ. কবরস্থান এবং শহীদ মিনারে যারা শ্রদ্ধার্ঘ্য ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে যাবেন, তাদেরকে অন্যদের অসুবিধার কথা ভেবে রাস্তায় বসা বা দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
গ. সর্বসাধারণের চলাচলের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রবেশ ও বাহিরের রাস্তায় কোনো প্রকার প্যান্ডেল তৈরি করা যাবে না।
ঘ. শহীদ মিনারে প্রবেশের ক্ষেত্রে আর্চওয়ের মাধ্যমে তল্লাশি করে সকলকে প্রবেশ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে ডিএমপি।
ঙ. শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে প্রচারকৃত নির্দেশনা সম্মানিত নাগরিকদের মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
চ. কোনো ধরনের ব্যাগ বহন না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ।
ছ. যেকোনো পুলিশি প্রয়োজনে শহীদ মিনার এলাকায় স্থাপিত অস্থায়ী পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়েছে।
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পবিত্রতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সবার সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে সেদিন বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউররা। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার প্রথম নজির এটি।
সেদিন তাদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। আর এর মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। একুশের প্রথম প্রহর থেকেই জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে ভাষাশহীদদের স্মরণ করছে।
/এনএএইচ/