বাংলা ভাষায় পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের গণপরিষদে গৃহীত হয় ৪ নভেম্বর ১৯৭২। পরবর্তীকালে গণপরিষদের নামকরণ হয় জাতীয় সংসদ। এটি কার্যকরের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল, বিজয় দিবসের প্রথম বর্ষপূর্তির দিন। সংবিধানটি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় রচিত হলেও এখানে বলা হয়, কোনো অর্থগত বিরোধ দৃশ্যমান হলে বাংলা রূপকেই অনুসরণ করা হবে। সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
এই সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১১ এপ্রিল ১৯৭২ সালে সে সময়ের আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। ১৭ এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কমিটি নানা পর্যায়ে মতবিনিময় করে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জনগণের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করা হয় এ সময়। কোনো দেশের জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণে সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি ছিল একটি অসাধারণ ঘটনা। বিভিন্ন পর্যায়ে পাওয়া অসংখ্য মতামত থেকে ৯৮টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়।
গণপরিষদে সংবিধানের খসড়া গৃহীত হয় ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে। কোনো দেশের সংবিধান জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত তা ছাপানো যায় না। এ কারণে প্রথমে খসড়া সংবিধানটি হাতে লিখে তাতে অলংকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বাংলা সংবিধান পর্যালোচনার জন্য ড. আনিসুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। অপর দুই সদস্য ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান এবং ড. মযহারুল ইসলাম। সংবিধান অলংকরণের জন্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে হাশেম খান, জনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায়চৌধুরী ও আবুল বারক আলভীকে নিয়ে শিল্পীদের একটি টিমকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
ড. আনিসুজ্জামান ও নেয়ামাল বাসির ছিলেন বাংলা বানানের শুদ্ধতা নিশ্চিতে সক্রিয়। শিল্পী আবদুর রোউফ সংবিধানটি হাতে লেখার দায়িত্ব পান। ১০৯ পৃষ্ঠার সংবিধানজুড়ে তার হাতের লেখা ও শিল্পীদের নান্দনিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে।
বাংলাকে শুধু সাংবিধানিক কাগজপত্রে নয়, সর্বস্তরে প্রচলনের উদ্যোগ নেয়া হয় বিভিন্ন সময়। বিদেশে যোগাযোগের বিষয়টি বাদ দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অফিস বা দাপ্তরিক সব কাজে বাংলা ব্যবহারের প্রথম সরকারি নির্দেশনা জারি হয় ১২ মার্চ ১৯৭৫ সালে। রাষ্ট্রপতির সচিবালয় গণভবন ঢাকা থেকে জারি করা এই নির্দেশনার স্মারক নম্বর ছিল ৭২৯/৯(৪০০)। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জারি করা এই আদেশে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে- এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সে অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলা চলতে দেয়া যেতে পারে না। এ আদেশ জারি হওয়ার সাথে সাথে সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা সরকারি অফিসসমূহে কেবল বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে।’
আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা চলছিল। ব্যক্তিপর্যায়ে কেউ কেউ উদ্যোগও নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়ার পর ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৬ সালে বাংলা ভাষায় ঢাকা হাইকোর্টে একটি ফৌজদারি রিভিশন দাখিলের চেষ্টা করেন অ্যাডভোকেট শামছ্উদ্দিন আহমদ।
আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহারের পাশাপাশি জাতীয় সংসদে সকল আইন বাংলায় প্রণয়নের লক্ষ্যে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সালে একটি বিল আনেন ড. টি আই ফজলে রাব্বী চৌধুরী। সরকারি অফিসে বাংলা ভাষার ব্যবহার না করলে তা অসদাচরণ বলে নির্দিষ্ট করা হয় এই বিলে। দেড় ঘণ্টা আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে বিলটি পাস হয়ে পরবর্তীকালে আইনে পরিণত হয়।
‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ শিরোনামের এই আইন অনুসারে বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তা হলে সে আবেদন বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।