বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৪৭ সাল থেকে যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে ওঠে, ১৯৫২ সালে তা পূর্ণতা পায়। তবে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তানি শাসকরা নানাভাবে আন্দোলনকারীদের দমনের চেষ্টা করে চলে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবছরই পুলিশি জেল-নির্যাতন চলতে থাকে।
এই নির্যাতন নতুন মাত্রা পায় ১৯৫৫ সালে। এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্তুতি যখন নেয়া হচ্ছিল, তখনই ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কালো ব্যাজ ধারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরপর সরকার শহীদ দিবস পালনের ওপরই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে আন্দোলনের আরেক মাইলফলক। সব ধরনের কর্মসূচিতে পুলিশের বাধার মুখে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ও জনতা ২১ ফেব্রুয়ারিতে পথে নামেন। এ ছিল দেশজুড়ে এক অস্তিত্বের সংগ্রাম। পুলিশের লাঠি, টিয়ারগ্যাস এবং গুলির পাশাপাশি চলে গণগ্রেপ্তার। ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’সহ বেশ কিছু পত্রিকায় এর প্রতিবাদে সম্পাদকীয় ও লেখা প্রকাশিত হয়।
ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটে। ৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। মার্চ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে হারিয়ে যুক্তফ্রন্টের বিশাল জয় ছিল ভাষা আন্দোলনেরই প্রত্যক্ষ প্রভাব। নির্বাচনে জয়ী হয়েই শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলা ভাষাকে স্বাধীন করার ঘোষণা দেন। যুক্তফ্রন্টের নেতাদের সাহসী কর্মকাণ্ডের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুতই এই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়।
পাকিস্তান গণপরিষদে ১২ আগস্ট ১৯৫৫ সালে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তৃতা করেন। একই বছর ২৫ নভেম্বর বাংলাকে সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবিতে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। বাংলা ভাষা নিয়ে উচ্চতর গবেষণা ও ভাষার বিকাশে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা হয়।
ব্যাপক আন্দোলনে নাজেহাল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করে বাংলাকে দূরে সরিয়ে রাখতে। তারা রাষ্ট্রভাষার পরিবর্তে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়ার চিন্তা করে। ৮ জানুয়ারি ১৯৫৬ সালের খসড়া শাসনতন্ত্রে এ বিষয়ে প্রস্তাবও করা হয়। আইন পরিষদে ও বাইরে আবারো প্রতিবাদ শুরু হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে খসড়া শাসনতন্ত্রের কৌশলী অবস্থানের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে সে সময়ের উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তা কুমতলবে করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা চলবে না। বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক।’
রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন গণপরিষদের অধিবেশনে ফরিদপুরের রাজনীতিবিদ আদেল উদ্দিন আহমদ একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তাতে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন তিনি। তার প্রস্তাব গণপরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।
একই দিন পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন।
২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ গণপরিষদে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়। এর ২১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ও বাংলা।