ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল-এর মূল চরিত্র জ্যা ভালজা ছেলেবেলায় বাবা-মা হারিয়ে বোনের সংসারে আশ্রয় নেন। কিন্তু ভাগ্যের কষাঘাতে বোনের জামাই মারা যাওয়ায় ২৫ বছর বয়সে সাত সন্তানসহ বোনের সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়। কিন্তু এক শীতে কাজ না পাওয়ায় বাচ্চাদের খাবার সংগ্রহে রুটি চুরি করতে বাধ্য হন ভালজা এবং হাজার মিনতির পরও তার রক্ষা হয় না, পাঁচ বছরের জেল হয়। তিক্ত হৃদয় উপলব্ধি করে, সমাজ গরিবের রুটির ব্যবস্থা না করতে পারলেও ঠিকই জেলে পুরে দেয়।
এরপর বারবার জেল ছেড়ে পালানোর চেষ্টার ফল হিসেবে ৫ বছরের সাজা দাঁড়ায় ১৯ বছরে। ২৫ বছরের ভালজা বের হন ৪৬ বছরে। দরিদ্র ভালজা এবারে ঘুরে দাঁড়ান বিশপ মিরিয়েলের অর্থ-সহায়তায়, অলংকার বাণিজ্যের মাধ্যমে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে এবারেও এক মিথ্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হন। দগ্ধ ভালজা এবার পালিয়েই যান এবং কোজেত নামের এক শিশুকে দত্তক নেন। কিন্তু দিনে দিনে যুবতী হয়ে ওঠা মেয়েও বেশি দিন সাথী হয় না, মারিয়াসের সঙ্গে প্রেম-প্রণয়ে ঘর ছাড়েন এবং ভালজাকে ভুল বোঝেন। জীবনের অন্তিম শয়নে তখন ভালজা প্রতীক্ষা দাঁড়ায় মেয়ের মুখ দর্শনের।
শেখ হাসিনার জীবন উপাখ্যান লা মিজারেবলের মতো হুবহু না হলেও বেদনার দর্শন প্রায় কাছাকাছি। দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের ফলাফল হিসেবে বাবা-মাসহ পুরো পরিবার হারানো শেখ হাসিনাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে পরবাসে। এরপরও সরাসরি মৃত্যুর হুমকি, বুলেট, গ্রেনেড এবং হেলিপ্যাডে বোমার মতো মৃত্যুর মিছিলকে চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনরুদ্ধারে ব্রতী হয়েছেন। এক কথায় সব হারিয়েও দায়িত্ব বয়ে চলেছেন। তবে তাকেও অন্যায্যভাবে জেলে যেতে হয়েছিল।
তবে শেখ হাসিনা ভালজার মতো পালিয়ে বাঁচতে চাননি বরং ন্যায্যতার প্রশ্নে লড়াই করে প্রতিনিয়ত বিজয় হাসিল করেছেন। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ ‘পদ্মা সেতু’। যদিও এ নিয়ে কটূক্তিও কম হয়নি। কারণ দেখা গেছে এর প্রতিটি স্প্যান বসানো নিয়েই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এ নিয়ে চিন্তার বিশেষ কিছু নেই। কারণ উদযাপনের অভ্যাস কিংবা ইতিহাস কোনোটাই এখানে পূর্বাপর হয়ে ওঠেনি। যদি থাকত তাহলে পদ্মার বুকে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির ওপর প্রথম স্প্যান এবং ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর ৪১ নম্বর স্প্যানটি বসানোর পর তা উদযাপনে রাজনৈতিক বিভেদের বাইরে সবার চোখে-মুখে ভাসত।
সময়ের স্রোত কিছু মানুষকে নির্মাণ-বিনির্মাণ করে ভবিষ্যৎ ইতিহাসের জন্য। শেখ হাসিনা সেই আত্মবিশ্বাস যিনি প্রবল নিরুৎসাহ, অসহযোগিতা এবং ষড়যন্ত্রের দামামায় বাংলার সততা এবং স্পর্ধার স্মারক পদ্মা সেতুকে বাস্তবায়নে এককভাবে এগিয়ে গেছেন। বলা বাহুল্য নয় তৎকালীন অনেকেই পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অপবাদ মেনে তাদের অংশগ্রহণ কামনা করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনাই সাদাকে সাদা এবং কালাকে কালা চিহ্নিত করে সব মিথ্যা প্রমাণ করেছেন এবং বাংলার সত্যকে চরম সুন্দরের মর্যাদায় নিয়ে গেছেন।
শুধু তা-ই নয়, এই উদ্যোগ যে লা মিজারেবেলের সামাজিক বাস্তবতার মতো কাউকেই কর্মহীন ক্ষুধাসম্পন্ন মানুষ রাখবে না, তার পরিসংখ্যান খোদ বিচ্ছেদ ও অপবাদ দেয়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) করেছে। তাদের মতে, এই সেতুর কারণে প্রায় ৩ কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে, দারিদ্র্য কমবে ১ দশমিক ৯ হারে এবং দেশের মোট জিডিবির সঙ্গে আরো ১ দশমিক ২ শতাংশ যুক্ত হবে। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত হবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগও তৈরি হবে। ভিন্নভাবে বললে, পরিকল্পিতভাবে দুই পাশেই অর্থনৈতিক জোন তৈরির ক্ষেত্র রচিত হবে।
শেখ হাসিনার কারণেই বাঙালি আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো বলতে শিখেছে, ‘বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’। আর এখানেই লা মিজারেবেলের জা ভালজার সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈপরীত্য। শেখ হাসিনা তার অমোঘ আরাধ্য দেশপ্রেমকে একের পর এক সিঁড়ি ভেঙে জীবনের জানান দিয়ে আপন করেছেন। আর ভালজা অপেক্ষায় রয়ে গেছেন।
লেখক: প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ
ই-মেইল: [email protected]