মহাশ্বেতা দেবীর জন্মদিন গেছে সদ্য। আমার জীবনের দুটি বছর ওনার সান্নিধ্যে কেটেছিল। আমি তখন মধ্যপ্রদেশে অপরাধপ্রবণ জনজাতিদের নিয়ে কাজ করছি। সব মিলিয়ে তিন মাস কাটিয়েছিলাম বাঁছরা, বেড়িয়া, কাঞ্জার, মঘিয়া, নাট- এ রকম কিছু জনজাতির সঙ্গে। এদের কারো নাম সামাজিকভাবে স্বীকৃত বেশ্যাবৃত্তির জন্য, কেউবা ডাকাতি করে, কারো পেশা ভিক্ষা।
কাগজে কিছু লেখা, একটি অসমাপ্ত বইয়ের খসড়া ছাড়া সেই জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি হলো তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে অজ্ঞানতার বিদেশি নকলনবিশির অন্ধকার সরিয়ে প্রাচীন ও গ্রামীণ ভারতবর্ষকে ছুঁয়ে দেখার অনন্য অভিজ্ঞতা।
এখানেই প্রথম বুঝি, যে ইতিহাস আমরা স্কুলে পড়ি, যে ইতিহাস শিক্ষিতজনেরা লেখেন, তা আসলে অসমাপ্ত ইতিহাস বা ইতিহাসের একটা দিক মাত্র এবং সেটা কোথাও না কোথাও সব রকমের বিদেশি প্রভুদের তুষ্টিকরণের জন্য লেখা।
এখানেই প্রথম বোঝা, ভারত আজও চলে সেই রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের বেঁধে দেয়া ছন্দে। শহরের শিক্ষিত সমাজে, ইংরেজি বইয়ে যা নিয়ে আলোচনা হয়, তা ভারতের অন্তরাত্মার খোঁজ রাখে না। সে জন্যই নারী স্বাধীনতা থেকে উন্নয়ন প্রকল্প সব প্রচেষ্টাই কিছু মানুষের স্বার্থ রক্ষায় শেষ হয়।
আমি আজ যা লিখি, যা বলি, তার পেছনে কুড়ি বছর আগের সেই অভিজ্ঞতার অবদান বিরাট। দুটি বছর আমার জীবনকে দেখার চোখ বদলে দিয়েছিল।
এগুলো কিন্তু সবই আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি। মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়নি বা সীমিত আলোচনা হয়েছে।
আমি অ্যাক্টিভিস্ট মহাশ্বেতা দেবীকে দেখেছি। ভারতে যারা ওনার কথা জানে, তারা মূলত অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেই ওনাকে মনে রেখেছে। আদিম জনজাতির অনেক মানুষের কাছে উনি ছিলেন শেষ আশ্রয়।
নিজের সামান্য অভিজ্ঞতা দিয়ে মিলিয়ে মনে হয়েছিল অ্যাক্টিভিজম ওনাকে অনেক ছোট গণ্ডিতে বেঁধে ফেলেছিল, কিংবা উনি নিজেই হয়তো বাঁধা পড়েছিলেন। সে কথা লিখেছিলাম ২০১৬ সালে ওনার মৃত্যুর পর ‘মহাশ্বেতা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায়।
যদি মনে রাখতে হয়, আমি ‘স্তনদায়িনী’র মহাশ্বেতা দেবীকেই মনে রাখব। মনে রাখব এক মাতৃসমা নারীকে, যিনি ভোপালের এক গেস্টহাউসে রাত্রিযাপনের সময়ে ওষুধ-ইনজেকশন নিয়ে কিছু নাচারিতে পড়ে, ইন্টারকমে ডেকেছিলেন।
ওষুধের পালা শেষ হওয়ার পর কেন জানি না জিজ্ঞেস করলেন ‘বর্ডার’ (সিনেমা) দেখেছিস? দেখিনি শুনে সে কী হা-হুতাশ। শিগগিরি দেখ। তারপরে বৃদ্ধ, অক্ষম গলায়, সিনেমার বিখ্যাত গানটা গুনগুনানোর চেষ্টা: ‘কে ঘর কব আওগে, বোলো কব আওগে’। সীমান্তে পাহারারত সেনা জওয়ানের প্রিয়ার আকুল আর্তি।
ওই কঠিন, ‘নো-ননসেন্স’ চেহারার আড়ালে বোধহয় একজন সাধারণ মা-ও থাকতেন।
লেখক: পাবলিক পলিসি বিশেষজ্ঞ, প্রাক্তন ডেপুটি এডিটর ‘দি হিন্দু বিজনেস লাইন’