যেকোনো উৎসবই জীবনের আনন্দেরই প্রতিবিম্ব। তবে এই প্রতিবিম্বের মধ্যে সাধারণ প্রতিমুহূর্তের প্রতিবিম্বর একটু পার্থক্য আছে। সূর্যের আলো নানান কিছুতে পড়ে তার প্রতিবিম্ব আমাদের শরীরে ফিরে আসে। তা আমাদের শিহরিত বা আনন্দিত করে না। কিন্তু যখন সমুদ্রের চড়ায় গিয়ে একটি বিশেষ মুহূর্তে মানুষ দাঁড়ায়, সে সময়ে সূর্যের পানিতে পড়া আলোর রশ্মি যখন প্রতিবিম্ব হয়ে মানুষের শরীরে ফিরে আসে, তখন মানুষ আলাদা শিহরিত হয়। আন্দোলিত হয় ভিন্নভাবে মন ও শরীর। ওই আলো তখন মনের ভেতর একটা আলাদা প্রাণ জাগায়। যে প্রাণ আনন্দিত প্রাণ। নিষ্কলুষ প্রাণ। তেমনি একটি উৎসবকে ঘিরে যখন মানুষ জড়ো হয়, তখন ওই উৎসব থেকে উৎসারিত আলো তার আন্দোলিত মনে ও প্রাণে নিষ্কলুষ ভালো লাগা জাগায়। যা তার প্রতিদিনের নানান জটিলতায় ক্ষয়ে যাওয়া হৃদয়ের ভালোবাসাকে আবার নতুন করে শাণিত করে। নতুন করে সে আবার চারপাশকে ভালোবাসে। তাই সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নানানভাবে তার জীবনে উৎসবের যোগ ঘটিয়েছে। আর এ কারণে প্রতিটি জাতি বা নরগোষ্ঠীর প্রতিটি সভ্যতাকে ঘিরে রয়েছে নানান উৎসব। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীতে নানান ধর্ম ও ধর্মীয় উৎসবের সৃষ্টি হলেও সংঘাত হয়নি সভ্যতার ভেতর দিয়ে আসা প্রাণের আলো জাগানো এই উৎসবগুলোর সঙ্গে। বরং সব নরগোষ্ঠী, সব জাতি তা পালন করে নিজেকে আনন্দিত ও আন্দোলিত করে।
বাঙালির উৎসবগুলো সবই বিভিন্ন মাস ও ঋতুর সঙ্গে যোগ হয়ে আছে। ঋতুবৈচিত্র্য ও মাসের বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। আর ঋতু এবং মাসের সঙ্গে যোগ থাকার কারণে এর কোনোটাই কোনো ধর্মের, বর্ণের বা গোত্রের নয়। সব বাঙালির। এই ভূখণ্ডের সব মানুষের। জীবনের ব্যস্ততায়, নাগরিক জীবন শুরুর প্রথম পর্যায়ের টানাপোড়েনে এর অনেকগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। অনেকগুলোকে নগরে তুলে আনা হয়েছে। দেয়া হয়েছে কিছুটা নাগরিক রূপ। সময়ের পরিবর্তনে এর কিছুটা রূপ বদলাবেই। এই স্বাভাবিক। তারপরেও এগুলো থাকবে প্রাণশক্তি জাগানোর শক্তি হিসেবে সবার জীবনে।
সাম্প্রতিককালে পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে মৌসুমি পালাগান অনেক কিছুকে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানো হচ্ছে। মৌলবাদীরা এর মিথ্যা ব্যাখ্যা দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকার মৌলবাদীদের ভয়ে এগুলো সংকোচন করছে। কাউকে লোকজ এই উৎসবের ধারা পালন করতে গিয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত লেগেছে- এ অভিযোগে জেলেও পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার অংশ এই উৎসবগুলো একে একে হারিয়ে যাবে। আর এগুলো হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনে আনন্দের প্রতিবিম্ব ফিরে আসার পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে। জীবন হবে লোহার খাঁচায় বন্দী কোনো জীবের মতো। সে জীবন আর যা-ই হোক আনন্দিত চিত্তে সামনে এগোয় না। অথচ জাতীয় মনোজগৎ বিকাশে সব থেকে বেশি দরকার আনন্দিত চিত্তে সামনে এগোনো জীবনযাত্রা। এর বিপরীতে যা কিছু সবই নিকষ কালো অন্ধকার। তাই অন্ধকারকে আমন্ত্রণ নয়। আনন্দের প্রতিবিম্বকে ধারণ করতে বাঁচিয়ে রাখতে হবে উৎসবগুলো। সব বাধা, সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে।